বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশের বিমানবহরে প্রথমবারের মতো সংযোজিত ৭৮৭ বোয়িং ড্রিমলাইনার বিমানের উদ্বোধনকালে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংস্থার ভাবমূর্তি উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
‘আমি চাই বিমানে যারা কাজ করবেন তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন, যাতে দেশের কোন বদনাম না হয় এবং দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল থাকে,’- তিনি ৭৮৭ বোয়িং ড্রিমলাইনার আকাশবীণা’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরো লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বিদেশী এবং স্থানীয় যাত্রীসা ধারণ সেই সাথে প্রবাসী বাংলাদেশেরীরা দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে তাদের মালপত্র নিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পাদন করতে হবে।’ তিনি এ সময় বিমান কতৃর্পক্ষকে নিরাপত্তার বিষয়টিতেও আরো গুরুত্বারোপ করার আহবান জানান।
২৭১ আসনবিশিষ্ট বোয়িং ৭৮৭ ড্রিম লাইনার উড়োজাহাজটির নাম রাখেন ‘আকাশবীণা’ প্রধানমন্ত্রী।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাজাহান কামাল বিশেষ অতিথি হিসেকে উপস্থিত ছিলেন।
বিমানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) মুহম্মাদ এনামুল বারী এবং বেসাসরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়ে দু’একটি দেশের আপত্তি থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তার একটা বিষয় ছিলো সেটা আপনারা জানেন। কোন কোন সরকার এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তাও আপনারা জানেন। যাই হোক, তারা সেটি প্রত্যাহার করেছে এবং নিরাপত্তার বিষয়টি এখন উন্নত হয়েছে।
তিনি নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক। তাই আমরা একটু সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে যে সম্মান অর্জন করেছিলাম সেটা হারিয়ে গিয়েছিল ’৭৫-এর ১৫ অগাস্টের পর থেকে। সেই সম্মানকে আবার আমরা ফিরিয়ে নিয়ে এসে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে যে উন্নয়ন করা যায়, সেটাও আমরা কিন্তু প্রমাণ করেছি।’
দেশে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকার সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অর্জনটা ধরে রেখেই আমাদের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতার হাত ধরেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্ম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরা মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল তাঁদের একটি নিজস্ব এয়ারলাইন্স হবে, যে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন বঙ্গবন্ধু। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৯ দিনের মাথায় জন্ম নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে বিমানের যাত্রা শুরু হয়েছিল ডাকোটা উড়োজাহাজ দিয়ে আর আজকে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার আকাশবীনা’র। ‘আকাশবীনা’র আজকের এই অভিষেকের দিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্য আরো একটি মাইলফলক, স্বপ্ন পূরণের দিন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিমানের প্রতি এতোই আন্তরিক ছিলেন যে, এর লোগো তৈরি এবং চূড়ান্ত করার কাজ তিনি নিজেই তদারকি করেন। তাঁর সাড়ে তিন বছরের সরকারের সময় ব্যাংকক, কলকাতা, কাঠমান্ডুও দুবাই আন্তর্জাতিক রুট চালু হয়। বিমানের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিমানের উন্নয়নের পাশাপাশি জাতির পিতা ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল এভিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নামে পরিচিত।
প্রধানমন্ত্রী অতীতে বিমানের দুরাবস্থার কথা স্মরণ করে বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সরকার পরিচালনায় এসে দেখি বিমানের অবস্থা খুবই নাজুক। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানকে পরিণত করে দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। তারা নিউইয়র্ক, ব্রাসেলস, প্যারিস, ফ্রাংকফুর্ট, মুম্বাই, নারিতা এবং ইয়াঙ্গুন রুটে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়। চরম লোকসান আর অব্যবস্থাপনায় বিমান মুখ থুবড়ে পড়ে।
তিনি বলেন, জরাজীর্ণ বিমান বহর, বিপর্যস্ত শিডিউল, অন্তহীন অভিযোগ। এ সঙ্কট উত্তরণে প্রয়োজনীয় কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করি আমরা।
একটু গান শোনার ব্যবস্থা অনেক বিমানে ছিল না, বিমানে বসে থাকলে প্রায়ই পানি পড়তো, টয়লেট টিস্যু বা তোয়ালে দিয়ে পানি আটকাতে হতো জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে কারণে সরকারে আসার পর পরই আমরা উদ্যোগ নেই। সেই উদ্যোগের ফলেই বিমান বহরে আজ নতুন নতুন আধুনিক বিমান সংযুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের বিমানবন্দরও অনেক আধুনিক হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সত্যিকার অর্থে একটি আধুনিক এয়ারলাইন্স হিসেবে বিমানকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর নির্দেশেই বিমান পরিচালনা পর্ষদ বিশ্বখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে ১০টি নতুন বিমান ক্রয়ের জন্য ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউএস ডলারের চুক্তি করে। সেই চুক্তির আওতায় ইতোমধ্যে বহরে যুক্ত হয়েছে ছয়টি বিমান। বাকি চারটির প্রথমটি বহরে যুক্ত হলো।
তিনি বলেন, আমাদের বিমান বহরে সংযুক্ত হওয়া পালকি, অরুণ আলো, আকাশপ্রদীপ, রাঙ্গাপ্রভাত, মেঘদূত ও ময়ূরপঙ্খী। আমরা নতুন নতুন আঙ্গিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিযে বিমানগুলোরও নামকরণ করি। আরেকটি ড্রিম লাইনার, বিমানের বহরে যোগ হবে নভেম্বর মাসে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, সে সময়ে আমাদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তখন হয়তো এখানে আসা বা এটা উদ্বোধন করা সম্ভব হবে না। তাই আমি চাই এটা দ্রুত এসে যাক এবং তার কাজ শুরু করুক। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যসমূহে বিমানের যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সরকার গত মাসে কানাডার সঙ্গে ৩টি ড্যাশ-৮ বোম্বারডিয়ার উড়োজাহাজ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাতে করে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক যোগাযোগটা আমরা আরো বাড়াতে পারবো।
বিমানের উন্নয়নে তাঁর সরকারের নানা উদ্যোগের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে এই বিমানবন্দরে বোর্ডিং ব্রিজ বলে কিছুই ছিলো না। বিমানবন্দরে নেমে হেঁটে বিমানে উঠতে হতো। আমরা সরকারে এসে এটির আধুনিকায়নের দিকে নজর দেই এবং উন্নত করার ব্যবস্থা নেই।’
উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রীর সামনে উড়োজাহাজটির একটি মডেল উপস্থাপন করা হয়। পরে বিমান বহরে যুক্ত নতুন এই উড়োজাহাজটি পরিদর্শন করেন তিনি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা জানান, উদ্বোধনের পর আজ সন্ধ্যায় ‘ড্রিমলাইনার আকাশবীণা’র প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। আকাশবীণায় আসন সংখ্যা ২৭১টি। এর মধ্যে বিজনেস ক্লাস ২৪টি আর ২৪৭টি ইকোনমি ক্লাস। বিজনেস ক্লাসে ২৪টি আসন ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটবেড হওয়ায় যাত্রীরা আরামদায়কভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন। দু’পাশের প্রত্যেক আসনের পাশে রয়েছে বড় আকারের জানালা। একইসঙ্গে জানালার বোতাম টিপে আলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। জানালা ছাড়াও কেবিনেও রয়েছে মুড লাইট সিস্টেম।
টানা ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম এই ড্রিমলাইনার চালাতে অন্যান্য বিমানের তুলনায় ২০ শতাংশ কম জ্বালানি লাগবে। এটি ঘণ্টায় ৬৫০ মাইল বেগে উড়তে সক্ষম। বিমানটির ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেক্ট্রিক (জিই)। বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হবে ইলেক্ট্রিক ফ্লাইট সিস্টেমে।