একুশের চেতনা চিরঞ্জীব

শাহরিয়ার সোহেল

 

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।’

 

বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি বাঙালির জীবনের সকল চেতনার মূল উৎস। মাতৃভাষার মান রক্ষা করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এ দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে ভাষা বিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘আমি মুগ্ধ আমি প্রীত, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের কথা আমার ভাষায় জানাতে পারব বলে আমার হৃদয় স্পন্দন বেড়েছে। সত্যিই গর্বিত আমি।’

 

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১১ শ্রাবণ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব রাখেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধীতা করেন। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার হীন চক্রান্ত চলতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এ ঘোষণায় জোরালো প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এরপর সকল স্তরের দেশবাসী ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রতিবাদকে আরও জোরালো ও দৃঢ় করতে থাকে।

 

‘সচেতনতার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রী

নানা মুখী হাজার লোকের এক অস্তিত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি।,

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জোরদার হয়। ঐ দিন পাকিস্তানি শাসকবর্গ ১৪৪ ধারা চালু করে। ছাত্র সমাজ সে ধারা ভেঙে ব্যাপক আকারে মিছিল বের করে। শুরু হয় গুলি বর্ষণ। শহীদ হন অনেকে। কবি বলে ওঠেন,

 

‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার?

উনিশশো বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি

বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।

এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি

এখন তোমোকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস!

তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো

বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’

 

এ হত্যাকান্ডের খবর সারা দেশে দ্রুত পৌঁছে যায়; এবং আন্দোলন আরও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে থাকে। পরবর্তীতে তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সরকার বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। একুশের চেতনায় ভাস্বর আজ বিশ্ববাসী। একুশের চেতনার ফলে, এ দেশবাসী বুঝেছিল মিষ্টি কথায় অধিকার আদায় হয় না। এর জন্য প্রয়োজন রক্তক্ষরণ। আর এর ফলেই ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জয়লাভ করে।

 

‘আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচূড়া থরে থরে, শহরের পথে

কেবল নিবিড় হয়ে কখনও মিছিলে কখনওবা

একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা

শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতির গল্পে ভরপুর

একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং।’

 

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো এর সাধারণ পরিষদ ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, ‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এ দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হবে।’ এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা সম্মানিত হল; এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালিত হয়। কবি বলেছেন,

 

‘মাগো, ওরা বলে

সবার কথা কেড়ে নেবে

তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না

বলো মা, তাই কি হয়?’

 

বাঙালির দামাল সন্তানেরা মার কোলে শুয়ে মাতৃভাষার গল্প শোনার ব্যবস্থা করেছে। এ জাতি বীরের জাতি। এরা হারতে শেখেনি। বাঙালি জাতির আত্মোপলব্ধির উত্তরণ ঘটেছে বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের মাধ্যমে। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি কোন বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ; যেন ‘সজীব লাভা ¯্রাবক আগ্নেয়গিরি’, কখনও অন্তর্দাহে গর্জন করছে আর কখনও চারিদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।’

 

মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, এসব সৃজনশীল লেখার ভেতর একুশের চেতনা কাজ করেছে প্রগাঢ়ভাবে। পরবর্তীতে এ চেতনা সমস্ত বাঙালির জীবনকে করেছে উচ্চকিত, আন্দোলিত এবং বিজয়ী। ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদযাপন শুরু হয়। সে সময় কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরী, সমাবেত কণ্ঠে একুশের গান-আবৃত্তি, শহীদদের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পন ইত্যাদি করা হতো। পরবর্তীতে এগুলি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এছাড়া ১৯৫৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা ও বইমেলার আয়োজন করা হয়। এ সব কিছুই একুশের চেতনার ফসল।

 

‘একুশে ফেব্রুয়ারি

তোমায় স্মরণ করি

মৃত্যুর শীষে যারা দিয়ে গেল, প্রাণ ফসলের দান

তুমি ইতিহাস বহো তারি।’

 

একুশের চেতনায় উচ্চকিত হয়ে বাঙালি জাতি গর্বিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে একুশের ভূমিকা অপরিসীম। একুশের জন্যই আজ আমরা একটি স্বাধীন জাতি সত্তায় পরিণত হয়েছি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এবং বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসাবে নিজেদের দাঁড় করাতে হবে। তাহলে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে।

 

‘একুশ ভাষার প্রাণ

একুশ করেছে দান

একুশ মোদের পাথেয়

একুশকে করো নাকো হেয়।’

 

শাহরিয়ার সোহেল : কবি

Print Friendly

Related Posts