কনিষ্ঠতম ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান

ড.সাইদুজ্জামান
জীবনাবসানের মাঝেই, আমার বাবা এ, কে, এম, হামিদুজ্জামান (এহিয়া) যা করতে পেরেছিলেন তা তিনি করতে পারেন নি জীবদ্দশায় l তিনি তাঁর জনতাকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন l “আমার জনতা” – বাবার ভাষা এমনধারাই ছিল l
৬৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর বন্ধু এবং রাজনৈতিক শত্রু উভয় পক্ষকেই বলতে শুনেছি তাঁরা তাঁকে কত ভালোবাসেন – কতখানি হৃদয়বান তিনি ছিলেন, কতটা সামাজিক, কতটা মিষ্টভাষী, কতটা স্নেহশীল l মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনের কারণে কারাবরণ করে তিনিই বস্তুত হয়েছিলেন ইতিহাসে কনিষ্ঠতম ভাষা সৈনিক l
মানুষের বহু কাঙ্খিত একটি কলেজের তিনিই ছিলেন মহাপ্রাণ প্রতিষ্ঠাতা l মাগুরা জেলায় নাকোল সম্মিলনী ডিগ্রী কলেজ সদম্ভে আজ তাঁর নাম বহন করছে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে l একটি সড়কের শোভা বাড়াতে আলোক সজ্জার মতো ব্যবহৃত আজ তাঁর নাম, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ “ভাষা সৈনিক এ, কে, এম, হামিদুজ্জামান (এহিয়া) সড়ক” সরাসরি কেষ্টপুর বিশ্বরোড হতে নাকোল বাজারে গিয়ে মিশেছে l বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে তাঁর ছবি সুসংরক্ষিত l সি, এম, তারেক রেজার “একুশ, ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস” গ্রন্থে একটি পাতার লাবন্য বর্ধন করেছে তাঁর নাম আর আলোকচিত্র l
এইসব স্বীকৃতি, এইসব মূল্যায়ন যারা করেছেন তাঁদের উদারতা অনস্বীকার্য্য l আমিও আজ এই সুযোগে জনসমাজকে জানাই অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা l
তবু মানুষের আজকের এই যথাযথ উপলব্ধি ও তজ্জনিত স্বীকৃতি আমাকে প্রায়ই বিস্মিত করে l তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, জনমুখে তাঁর সমালোচনা ছাড়া অন্য কিছু খুব সামান্যই আমি শুনেছি l মনে পড়ে লোকে বলতো তিনি ছিলেন নেহাত এক অন্ধ এবং ত্রুটিযুক্ত রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী ব্যক্তি l এখন, তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, চোখে পড়ে বিসদৃশ ঘটনাপ্রবাহ যার কোনো মিলই নেই একদিন মানুষ তাঁকে নিয়ে যা ভাবতো তার সাথে l
তাঁর মানস বাঙালি জাতির দুজন মনস্বী ব্যক্তি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের থেকে আদৌ ভিন্ন ধারার কিছু ছিল না l এ দুজন অনেক অর্থবহ ছিলেন বাবার কাছে l বাবা সত্যি বুঝতে পারতেন এই দুই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে l প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষাহীনতায় ভোগে, আমার বাবার জন্য এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মনোভঙ্গি l বঙ্গবন্ধু আমার বাবাকে জাগতিক অন্য সব কিছু থেকে অন্ধ করে রাখতেন, বাদ পড়িনি আমরাও, তাঁর নিজের সন্তানদেরকেও বাবা ঠিক খেয়াল করতে পারলেন না কখনো l
আমার নিজের বয়স যখন ১৬ বছর ছিল, বাবা আমায় তাঁর গল্পটি শোনালেন l বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার গল্প, ভাষা আনদোলনে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সাথে যোগ দেওয়ার গল্প l সেই সময়ে তিনি নিতান্তই একজন তরুণ ছিলেন l বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নেতৃত্বে আমার বাবা, একজন তরুণ, আন্দোলনের ডাক সজনে বিতরণ করতে তার হ্যান্ডবিল হাতে বেরিয়েছেন রাজপথে, জনসমাজকে জাগিয়ে তুলতে, নিজেকে এবং নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে, আর একই সাথে গ্রহণ করতে বিক্ষুব্ধতা এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের নব এই জীবনের সূচনা ক্ষণ l ২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৪ বেলুচ রেজিমেন্ট তাঁকে গ্রেফতার করে l তিনি কারাবদ্ধ হন l পরবর্তিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর যশোর সফরকালে আমার বাবার সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন l
তাঁদের দেখা হয়েছিল নিশ্চয়ই, দুই অসম ব্যক্তি বিস্ময়বিমুগ্ধ ভাবে একে অপরের চোখে চোখ নিশ্চয়ই রেখেছিলেন l এই গল্পটি এতই ব্যতিক্রমী ছিল যে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি আমার উপলব্ধি ঠিক কি রকম হওয়া উচিত ছিল l
আমার কলেজে পড়া শেষ হলে, আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করি, কিন্তু আমি নিজে চেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ার হতে l তিনি চেয়েছিলেন আমি বাড়িতেই থাকি, তাঁর পাশে এসে দাঁড়াই, তাঁর মানুষের পাশে এসে দাঁড়াই l এটাই ঠিক আমি যা চাইনি, এটাই ঠিক আমি যা করিনি l আমার দেশত্যাগ সম্পর্কে আমার যে উপলব্ধি ছিল তা হলো, বাবার ইচ্ছে পূরণ না করতে পারলেও আমি তাঁর সুপুত্র, দেশত্যাগের সাথে আমার দেশপ্রেম ব্যহত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তাছাড়া স্বদেশকে ভালোবাসা যায় সম্ভবত যতটা দূর থেকে, ততটা নয় কাছ থেকে l
আমার বাবার চোখে ভালো লাগেনি আমার মাত্র আঠারো বছর বয়সে দেশ ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রবাস জীবন গ্রহণ করা, তা যতই বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে হোক না কেন l আমি স্বীকার করছি আমার খুব একটা বাড়ি ফেরা হয়নি, যতটা আমার বাবা হয়তো চেয়েছিলেন l এখন খুব মনে হয় যদি বাবাকে সুখী করতে পারতাম, যদি বাড়িতেই থাকতাম, যদি একদিন এক ডাকসাইটে আইনজীবী হতে পারতাম, অথবা এক নামী দামী রাজনীতিবিদ, তবে হয়তো ভালই হত l
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাড়ি ফিরলাম, তাঁর সাথে সামান্য সময়ও কাটলো l তবে আমার এক দুঃসময় যাচ্ছিলো তখন l আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বাবার সাথে আরও একটু ঘন ঘন যোগাযোগ রাখা উচিত, বাবা-মাকে আমার আরো একটু বেশি জানা উচিত l আমি তাঁদের সাথে নিয়মিত ফোনে কথা বলা শুরু করলাম l
আমরা কথা বলতাম বস্তুত সব বিষয়েই l তিনি আমাকে তাঁর ভাবনার কথা বলতেন, তাঁর করণীয় কাজের তালিকার কথা বলতেন, সাফল্যের কথা, ব্যর্থতার কথা, সন্তোষের কথা, আশাভঙ্গের কথা l তিনি আমাকে রাজনীতি বোঝাতে চেষ্টা করতেন, যে সম্পর্কে আমার সেরকম কোনো ধারনাই মূলত ছিল না l তিনি বোঝাতে চাইতেন কিরকম নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারতো আমাদের দেশে যদি আমাদের জাতির পিতাকে হনন করা না হত l তিনি অনিবার্যভাবে আমাকে বোঝাতেন একটি জাতির জন্য তার পিতাকে হত্যা করার অর্থ কি হয় l আমার বাবা আমাকে বলতেন তাঁর উপলব্ধির কথা, তিনি যখন দেখতেন অসাধারণ প্রতিভাবান এবং কর্মঠ এই জাতির অবিশ্বাস্যরকম এক উন্মাদনা l
২০০৫ সালের শেষের দিকে ফোন করে জানলাম বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে l আতঙ্কিত, হিমায়িত আমি অতি কষ্টে কথা বললাম ফোনে আমার বাবার সাথে l তিনি যা বলতে পারলেন তার অর্থ হয়, তোমাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে l আমি অনতিবিলম্বে ঢাকায় গেলাম, ক্যানাডায় ফিরে আসার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত সর্বক্ষণ কাটালাম সেই হাসপাতালে যেখানে তাঁর চিকিত্সা হচ্ছিল l
তারপর এক সন্ধ্যায় ফোন এলো বাড়ি থেকে, তারা বললেন, “হয়ে গেছে” – তিনি জেগে ছিলেন, ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন ঠিক এক মুহূর্ত আগেও যখন তাঁর চোখের তারারন্ধ্র নিষ্পলক কাঁচের মতো স্থির হয়ে ওঠেনি l
আমার বাবার মৃত্যু আমার কাছে কোটি অর্থ বহন করে l আমি এখনো সেইসব অর্থ ও বার্তা আত্মীভুত করে চলেছি l তিনি আমাকে দেখিয়েছেন মুমূর্ষের প্রতি জীবিতের দায়িত্ব কি রকম হওয়া উচিত l
(১৯ আগস্ট মৃত্যুদিন)
Print Friendly

Related Posts