কালবৈশাখীর ছোবল শিলাবৃষ্টির আঘাত, নিহত ৬

কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক জায়গাতেই ভেঙে পড়েছে গাছপালা। কোনো কোনো স্থানে শিলাবৃষ্টি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, অনেক ঘরের চাল ফুটো হয়ে গেছে। শিলার আঘাতে টিনের চালা ফুটো হয়েছে পাবনা ও নীলফামারীতে। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, এত বড় শিলা তারা কখনও দেখেননি।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে শিলার আঘাতে সৈয়দ আলী (৫৫), মাগুরা সদর উপজেলার আকরাম হোসেন (৩৫) নামে দুই কৃষক, পাবনার ঈশ্বরদীতে জমেলা খাতুন (৫৫), সিলেটের ওসমানীনগরে সাবিয়া বেগম (৩০) এবং হাসান আহমদ নামে দেড় বছরের এক শিশু মারা গেছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের ছিঁড়ে পড়া তারে জড়িয়ে যশোরের অভয়নগর উপজেলায় লাইজু খাতুন নামে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন আরও শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে সিলেট দক্ষিণ সুরমা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোসাদ্দেক আলী মুসা রয়েছেন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সিলেট নগরী ও সুনামগঞ্জে ব্যাহত হয়েছে বিদ্যুৎ পরিসেবা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে রাস্তায় ও রেললাইনে গাছ ভেঙে পড়ে অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল সড়ক ও রেল যোগাযোগ।

শুক্রবার বিকেল থেকেই দেশের উত্তরাঞ্চলে কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকায় দমকা হাওয়ার সঙ্গে ধূলিঝড়ে দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে রাস্তায়। হঠাৎ হাওয়ায় ফুটপাতের অনেক দোকানের পলিথিন লণ্ডভণ্ড করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এ সময় যান চলাচলেও বিঘ্ন ঘটে। পথচারীরা দোকানের ছাউনি, অফিস বা রাস্তার পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় আশ্রয় নেন।

 

শুক্রবার বিকেলের কালবৈশাখীতে বিমান চলাচল, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বেশ বিঘ্ন ঘটে। রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিকেল সোয়া ৪টা থেকে তিন ঘণ্টার জন্য সতর্কতা জারি করে বিমানবন্দরের আবহাওয়া অফিস। এ সময় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া, দেশের অন্যান্য বিমানবন্দর থেকেও ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলো বন্ধ রাখা হয়।

এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক কাজী ইকবাল করিম জানান, কক্সবাজার থেকে রিজেন্ট এয়ারের একটি ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে এলেও ঝড়ো হাওয়ার কারণে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ ছাড়া ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটও বিলম্বে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে অবতরণ করে।

nilphamari
শিলার আঘাতে টিনের চালা ফুটো হয়েছে পাবনা ও নীলফামারীতে

সিলেট : সিলেটের ওসমানীনগরে কালবৈশাখীর কবলে পড়ে এক নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিকেলে তাজপুর ইউনিয়নের দশহাল এবং উমরপুর ইউনিয়নের সিকন্দরপুর গ্রামে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওসমানীনগর থানার ওসি মোহাম্মদ সহিদ উল্যা।

জানা যায়, ঝড়ের সময় তাজপুর ইউনিয়নের দশহাল গ্রামে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে আসা সাবিয়া বেগমের ওপর বাতাসে উড়ে আসা টিনের চাল পড়লে তার মৃত্যু হয়। তিনি পার্শ্ববর্তী বালাগঞ্জ উপজেলার বোয়ালজুড় ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের খালিছ মিয়ার স্ত্রী। এ ছাড়া ঝড়ের কবলে পড়ে উমরপুর ইউনিয়নের সিকন্দরপুর রংবরং গ্রামের সুমন মিয়ার দেড় বছরের শিশু সন্তান হাসান আহমদ পুকুরের জলে ডুবে মারা যায়।

এ ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে কালবৈশাখীতে নগরীতে অসংখ্য গাছপালা, বিলবোর্ড ভেঙে পড়েছে ও ঘরের চাল উড়ে গেছে। সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল পুরো নগরী। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপিত হলেও লো-ভোল্টেজ ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঝড়ের সময় বেশ কয়েকজন আহত হন। এর মধ্যে নগরীর কাজীবাজার ব্রিজে চটপটির ভ্যান উড়ে এসে যুবলীগ নেতা মোসাদ্দেক হোসেন মুসার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলে তিনি গুরুতর আহত হন। দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।

সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী রতন কুমার বিশ্বাস জানান, নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় ১১ কেভি সঞ্চালন লাইনের ওপর টিনের চাল পড়ে তা ছিঁড়ে যায়। এ ছাড়া কুমারগাঁওয়ে দুটি বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এগুলো মেরামতের পর শুক্রবার সকাল থেকে নগরীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসে।

দিনাজপুর : দুপুরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টির আঘাতে পার্বতীপুর উপজেলায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। দুপুরে চণ্ডিপুর ইউনিয়নের চৈতাপাড়া গ্রামে ক্ষেতে কাজ করার সময় শিলার আঘাতে মারা যান কৃষক সৈয়দ আলী।

পাবনা : ঈশ্বরদীতে শিলাবৃষ্টির আঘাতে জমেলা খাতুন নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। সন্ধ্যার কিছু আগে উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জমিলা খাতুন কামালপুর গ্রামের মৃত দেলবার হোসেনের স্ত্রী। স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে জমেলা খাতুন বাড়ির পাশে লিচু বাগানে ঝরে পড়া পাতা কুড়াতে যান। এ সময় প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শিলাবৃষ্টি শুরু হলে তিনি মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে লিচু বাগানে পড়ে যান। বৃষ্টি শেষে স্থানীয়রা লিচু বাগানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে আনার পর স্থানীয় হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া সুজানগর ও চাটমোহর উপজেলায় শুক্রবার দুপুরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বড় বড় আকারের শিলার আঘাতে শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন।

যশোর : যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ গ্রামে কালবৈশাখীতে বিদ্যুতের ছিঁড়ে পড়া তারে জড়িয়ে লাইজু খাতুন (১৯) নামে এক কলেজছাত্রী মারা গেছেন। এ সময় নওয়াপাড়া গ্রামের ফাতেমা বেগম ও প্রেমবাগ গ্রামের কলেজছাত্রী ঐশী খাতুন আহত হয়েছেন। নিহত লাইজু খাতুন যশোর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।

প্রেমবাগ ইউনিয়নের মেম্বার সৈয়দ শওকত হোসেন জানান, সন্ধ্যায় এলাকায় কালবৈশাখী বয়ে যায়। এ সময় প্রেমগ্রামের সৈয়দ পাড়ায় যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে বিদ্যুতের তারের ওপর পড়ে তার ছিঁড়ে যায়। ওই সময়ে লাইজু ও তার বান্ধবী ঐশী এবং লাইজুদের বাড়ি বেড়াতে আসা ফাতেমা বেগম দোকানে যাচ্ছিল। অসাবধানতায় পড়ে থাকা তারে জড়িয়ে লাইজু ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ সময় গুরুতর আহত ঐশীকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ও ফাতেমা বেগমকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

মাগুরা : মাগুরায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টির কবলে পড়ে আকরাম হোসেন নামে এক কৃষকের মৃত্যু এবং অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ঝড়ো বাতাসে গাছপালা ও অন্তত ৩০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বড় বড় আকারে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় সদর উপজেলার ডহরসিংড়া গ্রামের আকরাম হোসেন স্থানীয় বিলের ক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় বড় আকারের শিলার আঘাতে গুরুতর আহত হন। পরে এলাকাবাসী খবর পেয়ে তাকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

সুনামগঞ্জ : শুক্রবার ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশ্বম্ভ্ভরপুর এলাকায়। সুনামগঞ্জ-ছাতকের ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ লাইনে গাছ উপড়ে পড়ায় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। এ ছাড়া বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাদাঘাট দক্ষিণ ইউনিয়নের বাঘমারা, ভাটিপাড়া ও দুর্গাপুর গ্রামের বেশ কিছু ঘরবাড়ি ও হাওরের বোরো ধানেরও ক্ষতি হয়েছে।

রাজশাহী : জেলা আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম জানান, বিকেলে কালবৈশাখী আঘাত হানে। এ সময় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এক মিলিমিটার। এরপর আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে আসে।

ময়মনসিংহ : বৃহস্পতিবার রাতে বয়ে যাওয়া ঝড়ে ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুরের বিভিন্ন গ্রামে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি ও গাছপালা। ওইদিন রাত ৮টার দিকে সোহাগী ও আঠারবাড়ির মাঝামাঝি এলাকায় একটি গাছ উপড়ে রেললাইনে পড়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে দমকল কর্মীরা গাছ সরানোর পর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আঠারবাড়ি-ঈশ্বরগঞ্জ সড়কে অর্ধশতাধিক গাছ উপড়ে পড়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার বিকেলে আবার যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এ ছাড়া সড়কটির বেশ কয়েকটি স্থানে খুঁটি উপড়ে পড়ায় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

মুক্তাগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। দুপুর ২টায় মুক্তাগাছার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী বয়ে যায়। ঝড়ের সঙ্গে ঘন শিলাবৃষ্টিও হয়। এতে বোরো ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ : শুক্রবার ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পৌরসভার উত্তর ষোলপাড়া গ্রামের কৃষক আশেক আলী জানান, শিলাবৃষ্টির কারণের আম ও লিচুর মুকুল ঝরে গেছে।

রংপুর : শুক্রবার দুপুরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে পাঁচ শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেশবপুর বিএম কলেজের অধ্যক্ষ শাহীনুর আলম জানান, শিলাবৃষ্টিতে তার প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার নুরুর রহমান জানান, ঝড়ে কিছু জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ও তার ছিঁড়ে যাওয়ায় পরিসেবা ব্যাহত হয়েছে।

লালমনিরহাট : শুক্রবার সকালে দুই উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে ফসল, ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে পারেনি।

নাটোর :বজ্রপাতে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা যোগেন্দ্র নগর গ্রামের ছয়জনসহ বিভিন্ন এলাকার ৯ জন আহত হয়েছেন। শুক্রবার বিকেল ৪টায় হঠাৎ ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় শ্রমিকরা মাঠে কাজ করছিলেন। মাঠ থেকে রসুন নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে যোগেন্দ্র নগর রাবার ড্যাম এলাকায় বজ্রপাতে ছয় শ্রমিক আহত হন। অন্যদিকে পৃথকভাবে তিন গৃহবধূ আহত হন। তাদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

 

Print Friendly

Related Posts