শানিত যুক্তি এবং অসামান্য কথনের জন্য দলমত নির্বিশেষে প্রশংসিত ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু ২০০৯ সালে স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে তাঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করে। সেই থেকেই কথা বলার শক্তিও হারাতে থাকেন বাজপেয়ী। গত তিন দিনে তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আর জীবনে ফেরানো গেল না প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে।

বুধবার দুপুর থেকেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক হতে শুরু করে। বুধবার দুপুরে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যান কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়ালও। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী-সহ অনেকেই গত কয়েক দিন ধরে নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছিলেন তাঁর শারীরিক অবস্থার। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি দু’বার করে এইমসে ছোটেন। ফের যান রাহুল গাঁধীও। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। তখন থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল, অটলবিহারী বাজপেয়ীর ফেরার সম্ভাবনা কম। বিকেল ৫টার পরে মেডিক্যাল বুলেটিন প্রকাশ করে এইমস কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, বাজপেয়ী আর নেই। শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা দেশে।অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্য গত কয়েক দিন ধরে প্রার্থনা শুরু হয়েছিল গোটা দেশেই। যে লোকসভা কেন্দ্র থেকে তিনি বার বার জিতেছেন, সেই লখনইয়ের বিভিন্ন স্কুলে পড়ুয়ারা প্রার্থনা শুরু করেছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আরোগ্য কামনায়। কোথাও বাজপেয়ীর সুস্থতা চেয়ে যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল। কেউ মাজারে গিয়ে চাদর চড়িয়েছিলেন। গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলেই উদ্বেগের ছাপ দেখা যাচ্ছিল গত কয়েক দিন ধরে। প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতি, কংগ্রেস সভাপতির বাইরেও রাজনীতির আরও অনেক রথী-মহারথী গত কয়েক দিন ধরে খোঁজ নিচ্ছিলেন অটলের শারীরিক অবস্থার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই ভিড় আরও বেড়ে যায়।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করে বৃহস্পতিবার সকালে এইমসে ছোটেন বাজপেয়ীকে দেখতে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও অন্য সব কর্মসূচি বাতিল করে দিল্লি পৌঁছন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাও যান হাসপাতালে। বাজপেয়ীর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী তথা বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এইমসে যান মেয়ে প্রতিভাকে সঙ্গে নিয়ে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও বৃহস্পতিবার সকালে এইমসে গিয়ে বাজপেয়ীকে দেখে আসেন। কিন্তু দেশজোড়া প্রার্থনাতেও কাজ হল না। সব যজ্ঞ, সব প্রার্থনা, সব শুভেচ্ছাকে ব্যর্থ করে চলে গেলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।

১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯— তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। প্রথম দফায় তেরো দিন, দ্বিতীয় দফায় তেরো মাস আর তৃতীয় দফায় পূর্ণ সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দায়িত্বভার সামলেছেন তিনি। ২০১৪ সালে মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়া দেশ বাজপেয়ীকে মনে রাখবে এক দুর্দান্ত সাংসদ, কবি, বাগ্মী ও গণতন্ত্রের এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবেও। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজধর্ম বরাবরই তাঁর কাছে ছিল প্রথম প্রাধান্যের বিষয়। ২০০২ সালে গুজরাতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হিংসা চলাকালীন সে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন এই বাজপেয়ীই। ভারত যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হয়, তা হলে ভারত ভারতই নয়— এমন মন্তব্যও শোনা গিয়েছিলেন তাঁর মুখে।

১৯২৪ সালে গ্বালিয়রে জন্ম বাজপেয়ীর। বাবা কৃষ্ণবিহারী বাজপেয়ী কবি ছিলেন। দীর্ঘ এবং ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনের ফাঁকে অবসর খুঁজে নিয়ে অটলবিহারীও কাব্যচর্চা করতেন নিয়মিত। গ্বালিয়রেই আর্যসমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন অটল। তখন ছাত্রাবস্থা। তার পরে যোগ দেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন পরবর্তী কালে। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টি সরকারে মন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু পরে সঙ্ঘ-পন্থী অন্য নেতাদের সঙ্গে বাজপেয়ীও জনতা পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, গঠিত হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম সভাপতিও হন বাজপেয়ী। তার ১৬ বছর পরে প্রথম বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র হার হয়। পরাজয়ের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে প্রধান বিরোধী দলনেতার পদ নিতে অস্বীকার করেন তিনি। ক্রমশ সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরেও সরিয়ে নেন নিজেকে। এ বার জীবন থেকেই বিদায় নিয়ে নিলেন বাজপেয়ী।