জাবির কলা ও মানবিকী অনুষদ : মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার

মুহাম্মদ মূসা, জাবি প্রতিনিধি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তিতে আসন বরাদ্দের ক্ষেত্রে মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যাপক বৈষম্য করা হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর (২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে) বৈষম্য কয়েকগুণ বেড়েছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত সি ইউনিটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। এ অনুষদে মোট ৩৩৭ টি আসনের মধ্যে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র ১৩টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে মাদ্রাসার বোর্ডের সিলেবাসের পুরোপুরি মিল থাকলেও মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদেরকে আলাদা শাখায় বিভক্ত করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে একত্রিত করা হয়েছে।

জানা যায়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসের সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মিল উল্লেখযোগ্য নয়।

এদিকে সি ইউনিট কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত হলেও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক বেশি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত ’সি’ ইউনিটের প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ অনুষদের মোট আসনের বিপরীতে দশগুণ মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সে হিসেবে বিজ্ঞান বিভাগের ছেলে ৭৯, মেয়ে ৭৯; মানবিক বিভাগের ছেলে ৭৭, মেয়ে ৭৭; ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছেলে ২১, মেয়ে ১৭ এবং মাদরাসা ও টেকনিক্যাল বিভাগের ছেলে ১১ এবং মাত্র ২ জন মেয়ের প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রকাশিত ফলাফলের মেধা তালিকাকে ১০ ভাগ করলে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন সংখ্যক আসন বরাদ্দের কথা রয়েছে। ‘মানবিক’ ও ‘বিজ্ঞান’ বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় সমান সংখ্যক সিট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভর্তিচ্ছুদের অভিভাবকরা বলছেন, কোন সুনির্দিষ্ট কারণ ও আইনত ভিত্তি ছাড়াই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদেরকে তাঁদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

তাঁদের অভিযোগ, কলা ও মানবিকী অনুষদে সাতটি বিভাগের বিপরীতে মাদরাসা ও টেকনিক্যাল বোর্ডের ২ জন ছাত্রী রাখার বিষয়টি প্রশাসনিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈষমের প্রমাণ দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিস সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা এবং ইংরেজি বিষয়ে স্কুল-কলেজের মতো মাদরাসার সিলেবাসে ২০০ নম্বর না থাকায় মাদরাসার শিক্ষার্থীদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ও গ ইউনিটের ৯টি বিভাগে ভর্তির সুযোগ বাতিল করে প্রশাসন। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশে পরবর্তীতে আবার মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ju-1

 

কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অফিসের সূত্র বলছে, কিভাবে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কম ভর্তি করানো যায় সে লক্ষ্যে প্রতি বছরই ভিন্ন ভিন্ন ফন্দি আঁটছে কলা ও মানবিকী অনুষদ কর্তৃপক্ষ। এমনকি ২০১১ পরবর্তী বছরগুলোতেও নানা শর্ত ও ভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে সুযোগ সীমিত করা হয়।

এছাড়া ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর ‘ জাবিতে ভর্তির ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাথে বিদ্যমান বৈষম্য কেন অবৈধ ও বেআইনী হবে না’ জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। এতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ফলাফল সম্মিলিত মেধা তালিকায় না রেখে ‘মাদরাসা ও অন্যান্য’ ক্যাটাগরিতে রাখাকে অবৈধ ও বৈষম্যমূলক বলে ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েও কলা ও মানবিকী অনুষদে ভর্তি হতে না পেরে এ রিট আবেদন করেন মো. সাইফুল ইসলাম ও ইসমাইল হোসেন নামের দুই শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮-১৯ সেশনের ভর্তিচ্ছু মাদরাসা শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সমপর্যায়ে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ২০০ নম্বর সিলেবাস পড়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরও কোন যৌক্তিকতা ছাড়াই মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাথে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদ কর্তৃপক্ষ।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু মাত্র কলা ও মানবিকী অনুষদে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সাথে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। অন্য বিভাগে সবার জন্য সমান সুযোগ দেয়া হয়েছে।

কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক এসব দায় স্বীকার করে বলছেন, ‘বিভাগগুলো মাদরাসা বোর্ডেও শিক্ষার্থীদের নিতে চাননা। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, বিভাগ না নিলে আমার কিছুই করার থাকে না।’

আর কয়েকটি বিভাগের সভাপতি জানান ডিনের গাফিলতির কারনে এ বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিচালনা কমিটির নজরে আনা হয়নি। দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোস্তফা নাজমুল মানসুর বলেন, ‘হাইকোর্ট এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদেরকে কখনো অবহিত করা হয়নি। তবে এখনো সুযোগ আছে, কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটি চাইলে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব।’

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমটির সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করব।’

Print Friendly

Related Posts