টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’

শৌল বৈরাগী

 

সম্প্রতি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত দরিদ্র বিমোচনে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্ত মায়েদের জন্য ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচীর সমাপ্তি প্রতিবেদন (P.C.R) mED/04/2003(Revised) মূল্যায়ণ কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। শ্লোগান ছিল, শেখ হাসিনার বারতা, নারী পুরুষ সমতা।

‘স্বপ্ন প্যাকেজ’১০টি জেলার ১০ উপজেলায় ৬০টি ইউনিয়নের ৭০০ জন মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগী মা ও তাদের পরিবারের দারিদ্র বিমোচনে বাস্তবায়িত হয়েছে। তন্মধ্যে ৫টি জেলার ৫টি উপজেলা সরেজমিনে মূল্যায়ণ করা হযেছে। মূল্যায়ণকালে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র (ডরপ) এর কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থেকে স্বপ্ন মা’দের বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ণে সহায়তা করেন। জেলা ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা এবং সরেজমিনে মূল্যায়ণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রনয়ন করা হয়েছে।

মূল্যায়ণকৃত উপজেলাগুলো হলোঃ মৌলভীবাজার’র শ্রীমঙ্গল, মেহেরপুর’র মুজিবনগর, গোপালগঞ্জ’র টুঙ্গীপাড়া, নোয়াখালী’র চাটখিল ও ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলা। প্রকল্প কাল জুলাই ২০১৩ থেকে জুন ২০১৭ (সংশোধিত)। মোট ব্যয় ৫৫০.০০ লক্ষ টাকা। কর্ম এলাকার অন্য ৫টি উপজেলা হলোঃ গাজীপুর’র কালিগঞ্জ, লক্ষীপুর’র রামগতি, নাটোর’র সিংড়া ও বদলগাছি এবং কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা।

দারিদ্র্য বিমোচনে ২ বছরের পাইলট কর্মসূচী গ্রহণ করে পার্টনারশিপের মাধ্যমে সম্পদ হস্তান্তর করা হয়ঃ ১. স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি কার্ড বিতরণ, ২. শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিনোদন কার্ড বিতরণ।  ৩. গৃহ ও পয়:নিস্কাশনসহ নিরাপদ পরিবেশের জন্য স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিন প্রতিজনে ২৫ হাজার আবাসন সহায়তা, ৪. জীবিকায়নের জন্য উপকরণ প্রদান এবং ৫. প্রয়োজনে কর্মসংস্থানে উন্নয়ন সংস্থা/ক্ষুদ্রঋণ এর সাথে লিংকেজ স্থাপন ও সঞ্চয় করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন টেকসইকরণ। বৃহত্তর অর্থে এই পাঁচটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন করা। প্রতিজন স্বপ্ন মা’কে জীবন-জীবিকা নির্বাহে নিয়মিত প্রশিক্ষণসহ ২৩ হাজার টাকা সমমূল্যের জীবিকায়নের উপকরণ হস্তান্তর করা হয়েছে।

৩০ জানুয়ারী থেকে শুরু করে এক মাস ব্যাপী প্রাপ্ত মূল্যায়ণ তথ্যের বিস্তারিত বিবরণসহ ৫ উপজেলায় মোট ৪৭ জন স্বপ্ন মা থেকে যেহেতু একই ফলাফল তারই কিছু উল্লেখ করা হলো।

 

১. স্বপ্ন মা’দের একজন মোছা: সালমা খাতুন, স্বামী রাজু বিশ্বাস, গ্রাম আনন্দবাস, ইউনিয়ন বাগোয়ান, উপজেলা মুজিবনগর এবং জেলা মেহেরপুর যার কোন বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল না। ঘর বলতে ছিল ছনের ছাউনি ও মুলিবাঁশের বেড়ার একটি একচালা ছাপড়া ঘর। স্বামী ছিল একজন দিন মজুর। সংসারে অভাব অনটন ও ঝগড়া বিবাদ সব সময়ই লেগে থাকত। কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় একটি বসত ঘর, একটি বকনা গরু, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, স্বাস্থ্য কার্ড, শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড পেয়েছে। বকনা গরুটি বাছুর দেয়ার পর বাছুরসহ বিক্রি করে ১ টি মুদির দোকান দেয় এবং ২টি মোষের বাচ্চা ক্রয় করে। ১ বছরের মাথায় মোষ দু’টি হালচাষের যোগ্য হওয়ায় তাঁর স্বামী অন্যের জমিতে হাল বিক্রি করে প্রতিদিন ১০০০-১২০০ টাকা আয় করেন। তাছাড়া সালমা খাতুন হাঁস ও মুরগী লালন পালন করেন। দোকানের আয় দিয়ে সংসার চলে। হাল বিক্রির টাকা এবং সালমা খাতুনের বাবার সহায়তায় ঘরটি বড় ও আধাপাকা করা হয়েছে।

২. গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পলি ঘোষ। কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় তার অবস্থাও ভাল ছিল না। বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল না। অন্যের ঘরে কোন রকমে থাকত। স্বামী ছিল বেকার। সংসারে অভাব অনটন সব সময় লেগে ছিল এবং ঝগড়া বিবাদেরও অন্ত ছিল না। কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পলি ঘোষ বসত ঘর, বকনা বাছুর, ল্যাট্রিন, স্বাস্থ্য কার্ড, শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড পেয়ে সেগুলো ব্যবহার করে বর্তমানে ৩টি গরু হয়েছে। গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে স্বামীকে ভ্যান কিনে দিয়েছে। বর্তমানে ৩টি গরুর বাজার মূল্য প্রায় ২ লক্ষ টাকা। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা যার মধ্যে সে প্রতিদনি ২০০ টাকা সঞ্চয় করে। আর এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ২ বিঘা জমি বন্ধক রেখেছে।

৩.        নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার তাছলিমা আক্তার, স্বামী মনোয়ার হোসেন। কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার আগে তার আয়ের কোন পথই ছিল না। ছিল না কোন বসত ঘর এবং অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো। কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে একটি বসত ঘর, বকনা গরু, স্বাস্থ্য কার্ড, শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড পেয়েছে। আর বর্তমানে তার ২টি গরু আছে। গরুর দুধ বিক্রি করে সেলাই মেশিন কিনেছেন। সেলাই মেশিনের আয় দিয়ে ঘরে গ্যাসের চুলা, বিদ্যুৎ লাইন নিয়েছেন ও প্রয়োজনীয় ফার্নিচার কিনেছেন। এছাড়াও ৩০ শতাংশ জমি বন্ধক রেখেছেন। ফলে তার পরিবারে এসেছে রূপ কথার গল্পের মত পরিবর্তন।

তিন সদস্য বিশিষ্ট মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের মাতামত ও সুপারিশ এ লিখেছেন, পরিদর্শনে দেখা যায় স্বপ্ন পরিবার ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, ভিটামাটি হীন, অবহেলিত। সংসারে অভাব ও দুঃখ কষ্ট লেগেই থাকত। জীবন জীবিকা দূরে থাক, মাথা গোঁজার কোন জায়গা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজের ঘরে বসবাস করছেন। তাদের মুখের হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা এখন বেশ সুখি পরিবার। প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে শাক-সবজির চাষ করেছেন। হাঁস-মুরগী লালন পালন করছেন। কেউ কেউ জমি বন্ধকের পাশাপাশি জমিও ক্রয় করেছেন। কেউ কেউ দোকান দিয়েছেন, কলা বাগান করেছেন, মাছের চাষ করছেন। গোবর দিয়ে মুঠা তৈরী করে আয় করছেন। তাঁরা এখন স্বাবলম্বি ২/১ জন জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রতিটি মা এখন সমাজ ও সংসারে মূল্যায়ন পাচ্ছেন। তাদের পছন্দ মত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তাদের সংসারে নারী নির্যাতন বন্ধ হয়েছে। প্রশিক্ষণ পাওয়ায় নিজেদের পাশাপাশি অন্যদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। জেলা উপজেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহন করেন। কর্মসূচী পরিচালকের তত্ত্বাবধান, সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা মাহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের নিবিড় মনিটরিং, সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ডরপ এর সমন্বয় এবং স্বপ্ন মা’দের পরিশ্রম সকল পরিবারকে ২ বছরের মাথায় তাদের সংসারের ব্যাপক উন্নতি এনে দিয়েছে।

বর্তমানে তারা স্বাবলম্বি ও সামাজিক ভাবে সচেতন। পারিবারিক ও পরিবেশগত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। পরিদর্শনে দেখা যায় ‘শ্রীমঙ্গল উপজেলার ২টি পরিবার ছাড়া বাকি ৮টি পরিবার এবং ভোলা জেরার দৌলতখান উপজেলার ১টি পরিবারের গরুর স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। উপকারভোগী ও শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে অত্যন্ত শীত ও কাঁচা ঘাসের অভাবে গরুর এ অবস্থা হয়েছে। কাঁচা ঘাস পেলে আবার ঠিক হয়ে যাবে। পরিদর্শনকৃত অন্যান্য সকল পরিবারের গরুর স্বাস্থ্য খুবই ভাল। বিশেষ করে টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগর, দৌলতখান ও চাটখিল উপজেলার প্রতিটি পরিবার সংসারের খরচের পরেও বর্তমানে ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকার সম্পদের মালিক। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা ছিল কর্মসূচিটি আবার চালু হবে কিনা।’ গরীবের সংগঠন র্ডপ এ প্রক্রিয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বকারী মহোদয়ের কার্যালয়, অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্প প্রণয়ন আবেদন নিবেদন অব্যহত রেখেছেন। সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়াও অন্যান্য উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাদের মতে প্রতিটি পরিবারই উন্নতির পথে এগিয়ে রয়েছেন।

পরিশেষে বলা যায় ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কর্মসূচি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করেছিল তা সফল হয়েছে। এটি একটি সফল কর্মসূচী। ক্ষুদ্র পরিসরে কর্মসূচিটির যাত্রা সফল হওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে কর্মসূচিটি তথা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্পর্কে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া জাগিয়েছে। ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়নের একটি রোল মডেল।

প্রতিবেদক এ প্রসঙ্গে জেনেছেন, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর প্রকল্পটি সারাদেশে সম্প্রসারন করার বাজেট, ব্যবস্থাপনা ও প্রদ্ধতিসহ মাঠে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

লেখক: উন্নয়ন সংগঠন ও গবেষক।

 

 

Print Friendly

Related Posts