ঢাকার কবর শ্মশানের হালচাল

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ঢাকা শহরে মরদেহ সৎকারের জায়গা এভাবেই খুবই সীমিত হয়ে গেছে। ঢাকায় বেশিরভাগ কবরই এখন দুবছর পর পর ভেঙে ফেলা হয়। নানা কবরস্থানে একই কবরে একের অধিক মৃত ব্যক্তিকে কবর দেয়া হচ্ছে। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে অসংখ্য কবর একটি আরেকটির গায়ে লাগানো।

কোন যায়গা অবশিষ্ট নেই। প্রচুর কবরের উপরে একের অধিক সাইনবোর্ড লাগানো। অর্থাৎ একের অধিক মানুষের জায়গা হয়েছে একেকটি কবরে। কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবার থেকে, ভিন্ন এলাকা থেকে তারা এসেছেন।

ঢাকায় ৮ টি সরকারি কবরস্থান রয়েছে। আজিমপুরের কবরস্থানটিতে ৩০ হাজারের মতো কবরের জায়গা হয়। ঢাকার বনানী কবরস্থানে রয়েছে ২২ হাজার কবরের জায়গা। ২০০৮ সাল থেকে দক্ষিণের জুরাইন ও আজিমপুরে আর ২০১২ সাল থেকে ঢাকা উত্তরের ৬ টি কবরস্থানে স্থায়ীভাবে আর কোন কবরের জায়গা দেয়া হচ্ছে না। ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ বছর, এরকম নানা মেয়াদে সেখানে জায়গা বরাদ্দ আছে খুব অল্প কিছু কবরের। যার জন্য দেড় থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। কিন্তু সেটি যারা পারছেন না তাদের জন্যেই অস্থায়ী কবর। আর সেই সংখ্যাটিই বেশি। দুবছর পর পর সেসব কবরে যোগ করা হয় আরেকটি মরদেহ।

১২ বছর আগে বোনের আত্মহত্যার পর থেকে বিভিন্ন উপায়ে তার কবরকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এমন একজন জানালেন, “আমার বোনের কবর আজিমপুরে দেয়া সিদ্ধান্ত হয়েছিলো কারণ আমরা ভাইবোনেরা সবাই ঢাকাতেই থাকি। ২২ মাস পর হঠাৎ জানতে পারলাম কবরটি ভেঙে ফেলা হবে। আমরা কবরটির দেখা শোনা করার জন্য একজনকে রেখেছি। প্রতি বছর হয় আগস্ট ও ফেব্রুয়ারি এরকম সময়ে সে খবর দেয় যে আপা কবর ভাঙবে। আমি তাকে প্রতি মাসে টাকা দেই কিন্তু ঐ সময়ে একটু বেশি দেই। এভাবেই ১২ বছর ধরে ওর কবরটা আমরা টিকিয়ে রেখেছি।”

ঢাকা শহরে মরদেহ সৎকারের জায়গা সকল ধর্মের জন্যই খুব সীমিত হয়ে গেছে। ঢাকার পোস্তগোলা ও কামরাঙ্গিরচরে রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মরদেহ সৎকারের জন্য রয়েছে দুটি সরকারি শ্মশান। রাজারবাগে কালি মন্দিরে রয়েছে বেসরকারি একটি শ্মশান।  জানা গেলো দিনে দুটির বেশি সৎকার এই শ্মশানগুলোতে হয়না। তাই বিষয়টি এখনো ঢাকার হিন্দুদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এক সময় বিশাল যায়গা নিয়ে তৈরি এসব শ্মশান এখন ভূমি দস্যুদের দখলে এক চিলতে জমিতে পরিণত হয়েছে।

ভূমির অভাবে কবর নিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছে ঢাকার খ্রিষ্টানদের সেমেটারি গুলো। তেজগাঁওয়ে হোলী রোজারী চার্চে রোববারের প্রার্থনা চলাকালীন সেখানে গিয়ে দেখলাম সাদা ক্রুশ চিহ্ন বসানো সারি সারি পাঁচশোর মতো কবর। অনেক ছিমছাম আর গোছানো সেগুলো। কিন্তু পাঁচ বছর পরপর একইভাবে পুরনো কবরে সমাহিত করা হয় নতুন মরদেহ।

প্রধান পুরোহিত ফাদার কমল কোরাইয়া বলেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ চার্চের সাথে সমাহিত হতে চান। সেখানে সবার স্থান সংকুলান আর সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, “আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনও অনুদান পাইনা। চার্চের কবরস্থানগুলো চার্চের পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কবরগুলো খুব যত্নে রাখা হয়। আমাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে চার্চে কবর হলে তা পবিত্র থাকে। তাই অনেকেই চার্চে কবর চান। কিন্তু বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। পাঁচ বছর পর আমরা যখন আবার খুড়ি, দেখা যায় হাড়গোড় বের হয়ে পড়ে এবং তখনো পচে নি। আমরা নতুন জমি কেনার চিন্তা করছি কিন্তু জমির যা দাম তা সম্ভব হবে কিনা কে জানে”

ঢাকায় খ্রিষ্টানদের জন্যে আরো দুটি কবরস্থান রয়েছে ওয়ারী ও মোহাম্মদপুরে। সেখানেও একই রকম অবস্থা।

মৃত্যুর পরও মরদেহের জন্য একটুখানি জায়গা যে দরকার হয় তা মাথায় রেখে সেভাবে কোনও পরিকল্পনাই করা হয়নি ঢাকা শহরে।

ajimpur-1
আজিমপুরের কবরস্থান

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগ জানায়, ব্যক্তিগত আবাসিক ভূমি উন্নয়ন বিষয়ক আইনে ঢাকা শহরে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক শূন্য চার একর জমি রাখার কথা বলা হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, মরদেহ সৎকার ও কমিউনিটির অন্যান্য সামাজিক সুবিধার জন্য। যেকোনো নতুন আবাসিক এলাকা তৈরির ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করেই এর পরিকল্পনা পাশ করানোর নিয়ম। এই নিয়ম করা হয়েছে মাত্র ২০০৪ সালে।

নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আফসানা হক বলেন, “১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য একটা মাস্টার মাস্টার প্লান হয়েছিলো। এরপর পরবর্তীতে প্ল্যান আমরা পেলাম ১৯৯৫ সালে। তারপর ২০১৫ সালের জন্য। ইন বিটুইন কোনও পরিকল্পনাই হয়নি। আর ৫৯ প্ল্যান একটা ধাক্কা খেয়েছিল কারণ সেটি মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী একটি পরিকল্পনা ছিল।”

তিনি বলেন যে জনগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছিলো সেটি অনেক বদলে গেছে। সেই জনগণের জন্য তৈরি পরিকল্পনা পরে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকার জনসংখ্যা এখন দেড় কোটির ওপরে। সরকারি হিসেব মতেই সেটি ২০৩৫ সালে এসে দাঁড়াবে আড়াই কোটির বেশি। সামনে যে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে সেটি সম্ভবত বলাই যায়।

ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সামনে কঠিন সময়, কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষ? দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, তার এলাকার অধিবাসীদের মরদেহ নিজেদের জেলায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং মরদেহ গ্রামে পৌঁছে দেয়ার ও সৎকারের জন্য কিছু খরচ দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, “ধরুন ঢাকা শহর থেকে টেকনাফ যেতে হবে বা কুড়িগ্রাম যেতে হবে। তার জন্য আমরা গাড়ির ব্যবস্থা করবো। আমরা যদি সেই ব্যবস্থা করি তাহলে হয়ত অনেকে ঢাকায় কবর দেয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবেন।”

আর ঢাকা উত্তর বানাচ্ছে নতুন কবরস্থান, বলেন এর প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মোঃ আবরাউল হাসান মজুমদার। তিনি জানিয়েছেন,  আমরা চেষ্টা করেছি নতুন কিছু কবরস্থান তৈরি করার জন্য। ঢাকার রায়েরবাজারে প্রায় ৮১ একর যায়গার উপর নতুন একটি কবরস্থান হয়ে গেছে। যেখানে ৯০ হাজার কবর ধরবে। সেটি সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় কবরস্থান। এছাড়া নতুন ১৮ টি ওয়ার্ড সংযুক্ত হচ্ছে উত্তরের সাথে। সেখানে নতুন কবরস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে। সুন্দর করে সাজানোর প্ল্যান যাতে ভাবগাম্ভীর্য বজায় থাকে। কিন্তু জায়গার অভাবে সেই ভাবগাম্ভীর্য অবশ্য ঢাকার বেশিরভাগ কবরস্থানেই নেই।

তবুও মৃত প্রিয়জনের একটি কবর সম্ভবত পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের জন্যই গভীর আবেগের বিষয়। অনেকের কাছেই কবর মানে শেষ আশ্রয়।

 

Print Friendly

Related Posts