তলস্তয় শেষ বয়সে সন্তের জীবন বেছে নেন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥  লিও তলস্তয়। খ্যাতিমান রুশ লেখক। দুটি অনবদ্য উপন্যাস ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস’ (রচনাকাল ১৮৬৩-১৮৬৯) ও ‘আন্না কারেনিনা’ (রচনাকাল ১৮৭৫-১৮৭৭) ছাড়াও লিখেন নাটক, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ। এ অমর সাহিত্যিক ১৮২৮ সালের এ দিনে (২৮ আগস্ট) রাশিয়ার তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন।

তার পুরো নাম লিও নিকলায়েভিচ তলস্তয়। তার বাবা নিকোলাস ছিলেন বিশাল জমিদারির মালিক। তলস্তয় ছিলেন পরিবারের চতুর্থ ছেলে। শৈশবে তার বাবা-মা মারা যান, এরপর ফুফুর কাছে বড় হন। তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শিখেছিলেন লাতিন, ইংরেজী, আরবী, তুর্কো-তাতার, ইতালীয়, গ্রিক ও হিব্রু ভাষা। সঙ্গীত ও চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী ছিলেন তিনি। তার একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার শক্তি ছিল অসাধারণ।

তলস্তয়ের ছিলেন কর্মোদ্যমী ও একগুয়ে স্বভাবের। বন্ধু-বান্ধব বা সমাজ কী বলবে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিজে যা উচিত ও ন্যায্য বলে ভেবেছেন তা-ই করেছেন সবসময়। যৌবনে প্রচুর ধার-দেনা করেছেন, বিষয়-সম্পত্তি নষ্ট করেছেন। পাদ্রী-পুরুতদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের সমালোচনা করেছেন। শাস্তিস্বরূপ যাজকরা তাকে খ্রিস্টধর্ম থেকে বহিষ্কার করে। অন্যদিকে, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বদাই মুখর ছিলেন। স্বনামে ও বেনামে জার-শাসনের সমালোচনা করে লেখা ছাপিয়েছেন। নিজের জমিদারিতে দরিদ্র চাষাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন, তাতে নিজে পড়িয়েছিলেন। দেশের দুর্ভিক্ষ হলে আক্রান্ত অঞ্চল সরেজমিনে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে ঔদাসীন্যের অভিযোগ এনেছেন, আদমশুমারিতে অংশ নিয়েছেন। বিস্ময়কর এ সব গুণের কারণে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল সমৃদ্ধ। যার ছাপ তার লেখায় পাওয়া যায়।

১৮ বছর বয়সে তলস্তয় পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা পান। পলিয়ানার বিশাল জমিদারি ও প্রায় ৩৫০ জন ভূমিদাসের মালিক হন। এ সময় কাজানের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে চলে যান জমিদারিতে। রুশোর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভূমিদাসদের উন্নতিতে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তারা তলস্তয়কে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তখন ঠিক করলেন কৃষকদের মধ্যে সময়ের অপচয় না করে পড়াশোনা আরম্ভ করবেন।

এবার পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হলেন। কিছুদিন পর পড়াশোনা ক্লান্তিকর হয়ে উঠলে ফিরে যান জমিদারিতে। সেখানেও ভাল না লাগলে যান মস্কোতে। এরপর বড়ভাইয়ের প্রস্তাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এই সময়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তীতে লিখেন বিখ্যাত গল্প— ‘প্রিজনার অব ককেসাস’ ও ‘কসাক’। প্রথম কিছুদিন যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠলেও ক্রমশই তার মনের মধ্যে যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণা সৃষ্টি হয়। এ সময় চলছিল সাহিত্য সাধনা। কয়েক মাস পরিশ্রম করার পর শেষ করলেন তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘চাইল্ডহুড’। স্থানীয় একটি পত্রিকায় লেখাটি পাঠিয়ে দিলেন। দুই মাস পর পত্রিকার সম্পাদক নেক্রাসভের চিঠি এল। উপন্যাসটি সম্পর্কে মুগ্ধতা জানান সেখানে। এরপর লিখেন দ্বিতীয় পর্ব ‘বয়হুড’। উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেন ছোটগল্প।

১৮৫৪ সালে তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যোগ দেন। কিন্তু যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন পিটার্সবার্গে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লিখেন তিনটি গল্প। আবার কিছুকাল জমিদারির দেখাশোনা। এর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৮৫৫ সালে রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাস মারা যান। সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। নতুন সম্রাট কিছু সংস্কারমূলক নীতি প্রবর্তন করলে তলস্তয় স্বাগত জানান। এতে অন্য সব জমিদার তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে, এমনকি তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। এ সব ঘটনায় মানসিক অশান্তিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘কসাক’। যা তাকে অসম্ভব জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে শুরু করেন উপন্যাস ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস’ ১৮৬৫ সালে পত্রিকায় উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৮৬৯ সালে শেষ খণ্ড ছাপা হয়। ১৮০৫-১৮১৩ সালের মধ্যে রুশ সমাজব্যবস্থা, সেই সঙ্গে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়ার আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি পরিবারের ভাঙাগড়ার খেলা এ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। একইভাবে নানা ভাঙ্গা-গড়ায় কাটতে থাকে মহান এ সাহিত্যিকের জীবন।

লিও তলস্তয়ের রচনার পরিমাণ ছিল বিশাল। ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, ডায়েরি ও চিঠিপত্র মিলিয়ে তার রচনা সমগ্র ৯০ খণ্ডে বিভক্ত। তার অনেক লেখা বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

১৮৬২ সালে সোফিয়াকে বিয়ে করেন তলস্তয়। তখন তার বয়স ৩৪ বছর, সোফিয়ার ১৮ বছর। এ দম্পতির ১৪ সন্তান।

তলস্তয় শেষ বয়সে সন্তের জীবন বেছে নেন। সব কাজ নিজে হাতে করতেন, এমনকি জুতো তৈরি করে পরতেন, চাষা-ভুষোর মত সাধারণ ও অল্প আহার করতেন, পরতেন ক্ষেত মজুরের পোষাক। শেষ বয়সে তিনি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পথিমধ্যে ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এতেই বাড়ি থেকে দূরের এক রেলস্টেশনে ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর মারা যান।

গ্রন্থণা : শাহ মতিন টিপু

Print Friendly

Related Posts