দুর্নীতিবাজরা নয়, যার জনপ্রিয়তা আছে মনোনয়ন তাকেই

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতিবাজরা নয় নিজ এলাকায় যার জনপ্রিয়তা আছে তাকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে। যেসব এমপি টাকা নিয়ে কাজ করেন, দূর্নীতি করেন, দলের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তারা নমিনেশন পাবেন না।

গতকাল আওয়ামী লীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গণভবনে দলের বিশেষ বর্ধিত সভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় দলীয় ঐক্য, নেতাকর্মীদের সংশোধন-সংযত হওয়া, জনগণের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা, অনুপ্রবেশকারীদের থেকে সাবধান থাকা ও উন্নয়ন প্রচারের উপর গুরুত্ব দেন তিনি। বর্ধিত সভায় সারাদেশের প্রায় চার হাজারের বেশি নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

সভায় দলের মন্ত্রী, এমপি, তৃণমূল নেতাদের সংশোধন ও সংযত হবার তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ভোটের রাজনীতি করতে হলে উন্নয়নের কথা জনগনের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমরা যে উন্নয়ন করেছি তাতে মানুষ নৌকায় ভোট দেবে না, তা হতে পারে না। যদি না দেয় সেজন্য তৃণমূলের আপনারাই দায়ী থাকবেন। কারণ তখন বুঝতে পারব, আপনারা সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতে পারেননি। তাদের কাছে সরকারের উন্নয়নের কথা বলতে পারেননি। ক্ষমতায় থাকতে আপনি জনগণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। টাকার বিনিময়ে কাজ করেছেন। এ কারণে জনগণ আপনাকে ভোট দেয়নি। দুঃসময়ে দলের হাল ধরে রাখা কর্মীরা যাতে অবহেলিত না হয় সেদিকে নজর রাখার নির্দেশ দেন তিনি।

অনুপ্রবেশকারীদের থেকে সাবধান থাকতে হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যারা অন্যদলের লোকজনকে দলে ভেড়াচ্ছেন তারা মনে রাখবেন, যাদের দলে ভেড়াচ্ছেন তারা আপনার আপন লোক নয়। এরা মামলা থেকে বাঁচতে অথবা মধু খাওয়ার জন্য দলে ভিড়ছে। এরাই কিন্তু আপনাকে খুন করে দলের বদনাম করবে। সুতরাং ওদের সম্পর্কে সচেতন থাকুন। ওরা কোনোদিনই আপনাদের আপন হবে না। দলের যে লোকজনকে আপনারা অবহেলা করছেন, তারাই আপনার আপন লোক।

আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামনে নির্বাচন, নির্বাচন মানেই তা চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য একটানা তৃতীয়বার। এই তৃতীয়বারের নির্বাচনে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে পারে, সেই চিন্তা নিয়ে কাজ করতে হবে। কে কী পেলাম না পেলাম সেই হিসাব না করে, দেশের জন্য কী করতে পারলাম, আগামীকে কী করবো সেটা মাথায় রেখে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।’

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘কে প্রার্থী সেটা বড় কথা নয়, নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে জনগণের কাছে যেতে হবে। নির্বাচনে আমরা যাকে প্রার্থী করবো, নৌকা মার্কা দেবো, তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। এজন্য এখন থেকে জনগণের কাছে যেতে হবে। নৌকা মার্কায় ভোট চাইতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জনগণ ভোট দেবে। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি করে কেউ আসতে পারবেন না। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। নির্বাচন যেন স্বচ্ছ হয়। কেউ যেন নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে না পারেন। আমরা ভোটচুরির বদনাম নিতে চাই না। জনগণের মন জয় করে তাদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হবে।’

দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দেশের জনগণ কিন্তু খুবই হিসাবী। কেউ দুর্নীতি করলে তারা তা ভুলে যায় না। কাজ করতে গিয়ে টাকা দেবে আর ভোট চাইতে গেলে বলবে টাকা দিয়ে কাজ নিছি ভোট দেবো কেন? জনগণের চোখ কিন্তু খুলে গেছে। সময় খুব বেশি নেই। পুরনো কেউ নমিনেশন পাবেন কিনা তা নির্ভর করবে আপনার এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারলেন আর কতটুকু তৃণমূলকে মূল্যায়ন করলেন, তার ওপর। কাজেই বলবো দুঃসময়ের যারা নেতাকর্মী, যারা দুঃসময়ে দলের হাল ধরে রাখে, তারা যেন অবহেলিত না হয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষ করছি, কেউ কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রার্থী হয়ে গেছেন। প্রার্থী হয়ে তারা বিএনপির লুটপাট-সন্ত্রাসের কথা বলে না, তাদের বক্তব্যে এসে যায় আমার আওয়ামী লীগের এমপির বিরুদ্ধে, সংগঠনের বিরুদ্ধে।’

তিনি বলেন, ‘প্রার্থী হওয়ার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু প্রার্থী হতে গিয়ে আমার দলকে বদনামে ফেলবে, এটা কোনও মতেই মেনে নেবো না। এটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। আমার সরকার উন্নয়নের কাজগুলোর কথা না বলে কোথায় কার বিরুদ্ধে কী দোষ আছে, সেটা খুঁজে জনগণকে যারা বলবেন, তারা কখনও আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না। এটা পরিষ্কার কথা। আমি এগুলো কিন্তু রেকর্ড করছি। যারা দলের বিরুদ্ধে বদনাম করবে সে কী বোঝে না যে এতে তার ভোটও নষ্ট হবে। ১০ বছর সরকারে থাকার পর যদি কেউ দলের বিরুদ্ধে বদনাম করে তাহলে জনগণ তো তাকেও ভোট দেবে না। এটা হলো বাস্তবতা।’

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যে ঐক্য রাখতে হবে, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যারা রাজনীতি করি, এটা নিজেদের ভোগ বিলাসের জন্য না। আমরা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করি। মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম, সে চিন্তা করাটাই একজন রাজনীতিকের জীবনের বড় সম্পদ। রাজনীতি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, দেশ গড়ার জন্য।’

উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯ বছরে আমরা সমুদ্র তলদেশ থেকে মহাকাশে চলে গেছি। বাংলাদেশ এখন স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য। এটি আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশে কোনো ভিক্ষুক থাকবে না। আমরা ভিক্ষুকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ব। আওয়ামী লীগ মানুষের ঘরে ঘরে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা মানুষের জন্য কাজ করেছি। যার কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এদেশে রাজনীতিটা হয়ে গিয়েছিল শো-অফ করার জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা একদম প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত চলে গিয়েছি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি।’

জোটের রাজনীতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জোট করেছি, মহাজোট করেছি। দলের স্বার্থে এটা করতে হয়েছে। আগামীতেও আমরা এটা করবো। আমরা বন্ধু হারাবো না। সবাইকে নিয়েই থাকতে চাই। এজন্য যতটুকু আত্মত্যাগ করতে হবে তা করবো। বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বটা এক্ষেত্রে বেশি।’

এসময় বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল, যারা ক্ষমতার আশেপাশে ছিল শুধু তাদেরই ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে মানুষ খুন করেছে, দুর্নীতি করেছে, অত্যাচার করেছে।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালে পরিবার হারিয়ে আমি আওয়ামী লীগের কাছেই বাবার ভালোবাসা পেয়েছি, মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি, ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়েছি। আওয়ামী লীগের মধ্যেই আমি আমার পরিবারকে পেয়েছি।’

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এই ভবন নতুন ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ৯টায় ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

এ দিন সকাল ৮টার মধ্যেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও আশেপাশের এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা উপস্থিত হন। এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে উপস্থিত সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে ‘শুভ শুভ শুভ দিন, আওয়ামী লীগের জন্মদিন’ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।

পরে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনসহ পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এ সময় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ভবন এলাকা ত্যাগ করার পর যুবলীগ. কৃষকলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

Print Friendly

Related Posts