দেশম এখন মহানায়ক

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ খুব বেশি পেছনে তাকাতে হবে না। বিশ্বকাপের কদিন আগেও ফ্রান্সের কিছু গণমাধ্যম দিদিয়ের দেশমকে ভাসিয়েছেন সমালোচনার জোয়ারে। তাদের অভিযোগ-ফ্রান্স দলে সহস্র যোগ্য খেলোয়াড় থাকলেও কারোরই নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। এর সমুচিত জবাব যে সেই সব বোদ্ধারা পেয়ে গেছেন তা বোঝাই যায়। সেই দেশমই এখন মহানায়ক। সেই সংবাদমাধ্যমগুলোতেই চলছে তার নামের হর্ষধ্বনী।

ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ২০ বছর পর খেলোয়াড় হয়ে জিতেছিলেন ১৯৯৮ সালে, দুই দশক পর সেই দলটির কোচ হিসেবেও জিতলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট। কোচ উভয় ভুমিকায় ইতিহাসের মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে গড়লেন এমন কীর্তি, বসলেন দুই কিংবদন্তি মারিও জাগালো এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পাশে।
রাশিয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেও ফ্রান্সের শুরুটা ঠিক ফাইনালিস্টসুলভ ছিল না। আসরে তাদের শুরুটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভাগ্যপ্রসূত জয় দিয়ে।

গ্রিজম্যানের পেনাল্টি গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত জয়ের জন্য প্রতিপক্ষের আত্মঘাতি গোলের সুযোগ নিতে হয়। পরের ম্যাচে পেরুকে হারাতেও বেগ পেতে হয়েছে। আর ডেনমার্কের বিপক্ষে তো তারা জালই আবিষ্কার করতে পারেনি। তবু গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক আউট পর্বে উঠায় সমালোচকদের আকুপাকু মন স্থিরই ছিল।

নক আউট পর্বে এসেই একের পর এক ভেল্কি দেখাতে থাকেন দেশম। ফুটবল যে মাঠের বাইরে থেকেও খেলা যায় দেখিয়ে চলেছেন ৪৯ বছর বয়সী। দাবার চালের মত সু² চালে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে চলেছেন। এই কারণেই নির্দিষ্ট কোন ছক মেনে তিনি খেলছেন না। ম্যাচে তিনি পরিকল্পনা ঠিক করছেন প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও নিজেদের শক্তির জায়গা বুঝে। আরেকটু খেয়াল দিলে দেখা যাবে দলের প্রধান তারকা কিলিয়ান এমবাপের গতিকে তিনি কাজে লাগালেন সফলভাবে। প্রতিপক্ষের রক্ষণকে মাঝমাঠে তুলে এনে কয়েকটি লম্বা পাস থেকে মুহূর্তের পাল্টা আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ঝড় তুলছেন গ্রিজম্যান-এমবাপেরা।

এ কারণেই ৪-২-৩-১ ফর্ম্যাশনটাই তার কাছে বেশি পছন্দ। বলের দখল রেখে আর গোছালো আক্রমণে গোল পাওয়া যে খুব কঠিন কাজ সেটা তিনি ভালোমতই জানেন। জার্মানি, স্পেন, আর্জেন্টিনার অকাল বিদায় থেকে কিন্তু এই শিক্ষাই পাওয়া যায়। তাই দেশমের ছক অনুযায়ী বলের দখল থাকা-না থাকা মূখ্য নয়, মূখ্য হলো গোল পাওয়া; সে যেভাবেই হোক। তার আগে নিজেদের রক্ষণকে অটুট রাখাটাও নিশ্চিত করতে হবে। ফুটবল ভক্তদের মন ভরাতে না পারলেও দুটি কাজই ঠিকঠাকভাবে করে চলেছেন দেশম। আর তাতেই বাজিমাৎ।

শেষ ষোলয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তিন গোল খেলেও গতির ঝড়ে ঠিকই লিওনেল মেসির দলকে লন্ডভন্ড করে দেয় লেস ব্লরা। কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে ইস্পতসম রক্ষণের পরিচয় দেয় উমতিতি-ভারানে-মাইতুদিদের নিয়ে গড়া ফ্রান্সের রক্ষণ।

বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচের দিকে তাকালেও অনেককিছু স্পষ্ট ধরা পড়ে। রবার্তো মার্টিনেজের দল যেখানে ৬৪ শতাংশ বলের দখল রেখে গোলের সুযোগ তৈরি করেছে মাত্র নয় বার, এর মধ্যে তিনটি মাত্র শট তারা পোস্টে রাখতে পারে। সেখানে মাত্র ৩৬ শতাংশ বলের দখল নিয়েও এমবাপে-গ্রিজম্যানদের গতিকে কাজে লাগিয়ে ১৯বার গোলের সুযোগ তৈরি করে দেশমের ফ্রান্স; ৫টি শট ছিল লক্ষ্যে। অলিভার জিরুদ সহজ কয়েকটি সুযোগ হাতছাড়া না করলে ম্যাচের ফল ভিন্ন হতেও পারত।

সেই কিঞ্চিৎ সমালোচনার সুযোগও দিলেন না দেশম। নিজের কারিশমা যে তখনও দেখানো বাকি ছিল! জমিয়ে রেখেছিলেন মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়। সেটি এলোও। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। রাশিয়া দু’হাত ভরিয়েই দিল তাকে।

এই শিরোপা দিয়ে ইতিহাসের বিশাল একটা পাতায় উঠে গেছে তার নাম। এর আগে যে পাতায় প্রথম না লিখিয়েছিলেন ব্রাজিলের মারিও জাগালো, এরপর জার্মানির ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার। সেলেসাও দলের খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপ জয়ের পর কোচ হিসেবে ১৯৭০ সালে পেলের দলকে শিরোপার রাস্তা দেখিয়েছিলেন জাগালো। এর চার বছর পর পশ্চিম জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি জেতেন বেকেনবাওয়ার। এরপর কোচ হিসেবে ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে পশ্চিম জার্মানিকে বিশ্বকাপ এনে দেন তৎকালীন তারকা ডিফেন্ডার। দেশমের সামনে সুযোগ তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে বিরল এই তালিকায় নিজের নাম লিপিবদ্ধ করার।

১৯৯৮ সালে তার আধিনায়কত্বেই ঘরের মাঠে একমাত্র বিশ্বকাপটি জিতেছিল ফ্রান্স। ২০ বছর পর দেশটির দ্বিতীয় শিরোপা চুমুতে বনে গেলেন নায়ক থেকে মহানায়ক।

Print Friendly

Related Posts