দেশ সমাজ ও মানুষের স্বপ্নগাঁথা নিয়ে আহবাবের প্রথম বই

শিউল মনজুর

 

আদ্যোপান্ত একজন ভালোমানুষ বলতে যা বুঝায় আহবাব চৌধুরী খোকন আমার নিকট সে রকই একজন সুন্দর মানুষ। এই মানুষের অনেকগুলো ভালো গুণাবলীর মধ্যে একটি ভালোগুণ হলো তিনি লিখেন। যার লেখার ক্যানভাস হচ্ছে সমাজ ও মানুষ। সমাজ ও মানুষকে কেন্দ্র করেই তাঁর লেখার জগত গড়ে উঠেছে। তার লেখার মধ্যে উঠে এসেছে সমাজের অগ্রগতির চিন্তা। তার লেখার মধ্যে উঠে এসেছে মানুষের মঙ্গল চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে সমাজ বদলের জন্য এমন লেখকই আমাদের প্রয়োজন।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই গুণি লেখকের প্রথম বই- নাম, কালের ভাবনা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য কলাম নিয়ে প্রকাশিত ১৬০ পৃষ্টার কালের ভাবনা বইতে স্থান পেয়েছে ৩৭টি কলাম।

এ গুলির শিরোনাম হচ্ছে এসো হে বৈশাখ, দেওয়ান আজরফ; জ্ঞানের বাতিঘর, মার্চের আহ্বান জাগ্রত হোক সবার প্রাণে, আপন মানুষ, শহীদ দিবস অমর হোক, মক্কা মদিনায় স্মরণীয় দিনগুলো, শাহ আব্দুল করিম; বাউল সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি, চিরভাস্বর ওসমানী, খোশ আমদেদ মাহে রমজান, বিজয় দিবসের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, চলে গেলেন জাহেদ ও নাজমুল, মুছে যাওয়া স্মৃতিময় দিন, প্রবাসে পরবাসী, ব্রক্সসে পিঠা উৎসব; ফুটে উঠেছে শ্বাশত বাংলার রূপ, সাইফুর রহমানকে যেমন দেখেছি, এমন তো হবার কথা ছিল না, স্কুলের সেই নানা রঙের দিনগুলো, কাসেম আলী মডেল হাইস্কুল; শতাব্দীর মহীরুহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিতে কাসিম আলী স্কুল, ব্যথিত অন্তর, ভেজাল খাদ্যে বিপন্ন জীবন, নির্বাচনের সাতকাহন, একজন গোলাম রহমান, প্রসঙ্গ সড়ক দুর্ঘটনা, স্মৃতির আয়নায় অসাধারণ কিছু মুখ, মে দিবসের প্রত্যাশা, আলবেনীতে বাংলাদেশ ডে, বঞ্চিত মানুষের সহযাত্রী, সমকালীন প্রসঙ্গ, সমস্যায় জর্জরিত পর্যটন শিল্প, পিপিএম স্কুলের দিনগুলো, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্রশিল্প, কাতারের পথে পথে, মাধবকুন্ড; চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র, কবি দিলওয়ার ও তার সাহিত্যকর্ম, আমার দেখা নায়েগ্রা ফলস্, ঈদ-প্রবাসে ও স্বদেশে।

সূচিবদ্ধ এসব কলামের মধ্যদিয়ে লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন তার ভাবনাকে উপস্থাপন করার মধ্যদিয়ে দেশের কথা, সমাজের কথা, পরিবারের কথা বলেছেন। বলা যায়, তাঁর এইসব লেখায় ব্যক্তি মানুষের জীবনলিপি যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি শিক্ষা, দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার বিষয়ও লেখকের সাবলীল বর্ণনায় প্রকাশিত হয়েছে।

যেমন, আমাদের সমাজের একটি সার্বজনীন উৎসবের নাম পহেলা বৈশাখ। বাংলাসনের প্রথম মাসের প্রথম তারিখ পহেলা বৈশাখ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বাঙালী সমাজ বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করে। এ উপলক্ষে বাংলাভাষার বাঙালি সমাজ তাদের ঐতিহ্যের আলোকে নানা অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকে। লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন এসো হে বৈশাখ শিরোনামে, পহেলা বৈশাখ উৎসবের নানাদিক আমাদের সামনে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। তথ্যবহুল এই কলামের কিছু অংশ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো:

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালি সমাজে বৈশাখ উদযাপনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল মোঘল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে। আমাদের সমাজে যখন জমিদারি ব্যবস্থা চালু ছিল তখন বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষে জমিদারদের তাদের জমির খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এ সময় জমিদার, তালুকদার ও জোতদাররা প্রজাসাধারণের সম্মানে শুধু মিষ্টিমুখ করাতেন না, গ্রামেগঞ্জে আয়োজন করা হতো রথযাত্রা, পথমেলা, বাউলগান, পালাগান ইত্যাদি অনুষ্ঠানের। এভাবে পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে গড়ে ওঠা আচার অনুষ্ঠান কালক্রমে বাঙালিদের নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত হয়। এক সময় বৈশাখ মাস এলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহে দেখা যেত নতুন হালখাতা খোলার রেওয়াজ। এই সময় ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের প্রারম্ভে তাদের পুরনো হিসাব নিকাশ সম্পন্ন করে নতুন হালখাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে উৎসব আমেজ লক্ষ করা যেত। এখনো গ্রামবাংলার বড় বড় বিপনী বিতানে এমন রেওয়াজ প্রচলিত আছে। (পৃষ্টা-১৪)

কালের ভাবনা বইতে অর্ন্তভূক্ত আরেকটি কলামের নাম দেওয়ান আজরফ: জ্ঞানের বাতিঘর (পৃষ্টা-১৭), এই শিরোনামের তথ্যবহুল লেখা থেকে সাবেক জাতীয় অধ্যাপকের জীবনলিপি পাঠ করে আমরা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হতে পারি। বলা যায়, কালের ভাবনা গ্রন্থের প্রত্যেকটি কলামই সময় উপযোগি, অর্থবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কলাম বা রচনা সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত। প্রকৃতপক্ষে কালের ভাবনা দেশ ও সমাজ চিত্রের একটি স্পষ্ট দলিল। যে দলিল অধ্যয়নে আমরা আমাদের চিন্তা চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারি অথবা নতুন করে ভাবতে পারি।

বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে মুখবন্ধ। মুখবন্ধ লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক মানবজমিন এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তাঁর এই লেখা থেকে লেখক ও বই সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আমরা পেতে পারি। এখানে মুখবন্ধের কিছু অংশ পাঠকের জন্যে উল্লেখ করা হলো:

শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক যেন ছিন্ন না হয় তা আমরা সব সময় অনুভব করি। এক্ষেত্রে বাংলা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। কালের ভাবনা এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। আহবাব চৌধুরী খোকনের বয়ানে উঠে এসেছে দেশ ও দশের মানুষের কথা। লেখাগুলো পাঠ করলে একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে চিত্রিত হয়ে ওঠেন। কমিউনিটি সংগঠক হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি নিউইয়র্কে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। লেখালেখি এবং কমিউনিটি সংগঠক হিসেবে আহবাব চৌধুরী খোকনের এ অবস্থানকে, কালের ভাবনা আরো উচ্চ শিখরে নিয়ে যাবে- এ প্রত্যাশা করি।

লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন যদিও প্রবাসে অবস্থান করছেন এবং প্রবাসের কঠিন জীবনযাত্রার সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছেন তবু সারাক্ষণ দেশ ও মানুষের মঙ্গল চিন্তা তাঁর মননে ও চিন্তায় জেগে থাকে। যে কারণে দেশে বিদেশে বিভিন্ন সমাজ সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত। রাজনীতিও করেন। কাজের বাইরে প্রতিদিন তিনি সংগঠন গুলোর মাধ্যমে দেশ ও মানুষের কল্যাণ কাজে সময় ব্যয় করেন। আবার মানুষ ও সমাজকে সচেতন করার জন্যে লেখালেখিতেও ব্যয় করেন সময়। এই প্রতিভাবান লেখকের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তাঁর প্রতিভা ও পরিশ্রম তাঁকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই বইয়ের আরেকটি বিশেষ দিক উল্লেখ না করলেই নয়। বইটির সম্মানিত প্রকাশক আমারই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অকৃত্রিম বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী। কাইয়ুম চৌধুরী একজন সফল সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ। আমার প্রথম কবিতার বইটির প্রকাশকও তিনি। তাঁর কাছে ব্যক্তি শিউল মনজুরের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরীর এই উদারতা চিরস্মরণযোগ্য।

কালের ভাবনা বইটির বিষয় সূচিগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বইটির সুন্দর বাঁধাই, নান্দনিক প্রচ্ছদ, অফসেট কাগজে ঝকঝকে ছাপা আমাদেরকে বইটি হাতে নিতে উৎসাহিত করে। বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ অংকন করেছেন আমাদের দেশের তরুণ প্রচ্ছদ শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। ১৬০ পৃষ্ঠার এ বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন, তার বাবা মরহুম মজাহিদ হোসেন চৌধুরীকে। তিনিও ছিলেন সমাজের একজন গুণি মানুষ। বইটির একমাত্র পরিবেশক, দেশের সুপরিচিত প্রকাশনা সংস্থা উৎস। নয়াপল্টনের সানজানা প্রিন্টার্স থেকে ছাপা এ বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা।

 

 

imag

শিউল মনজুর: কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Print Friendly

Related Posts