নীলগাই ফারাক্কার পর এবার ঠাকুরগাঁওয়ে

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ভারতের ফারাক্কার পর এবার নীলগাই নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে তোলপাড়। গত বছরের নভেম্বরের শেষে নীলগাই দেখা যায় ফারাক্কার জঙ্গলে। এরপর সেই নীলগাইয়ের নীলচে আভা দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় কয়েক হাজার মানুষ। কারণ, নীল গাইয়ের নাম শুনেছেন ফারাক্কাবাসী। কিন্তু আগে কখনও ফারাক্কায় নীলগাইয়ের সন্ধান মিলেছে এমন কথা শোনেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই ফারাক্কায় নীলগাইয়ের খবর চাউর হতেই ফরাক্কা ব্যারেজ লাগোয়া জঙ্গলে উঁকি দিতে শুরু করেন সকলেই।

এ ঘটনার মাত্র কয়েক মাস পরেই নীলগাইয়ের দেখা মিলল বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ে। ঠাকুরগাঁও জেলার সদর ও রানীশংকৈল উপজেলার সীমান্তে কুলিক নদী পারাপার হওয়ার সময় একটি নীলগাই আটক করেন স্থানীয় জাহিদ, মকবুল, বুধুসহ কয়েকজন যুবক।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সদর উপজেলার পটুয়া এলাকায় পথচারীরা নীলগাইটিকে ধাওয়া দিলে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দৌড়ে যদুয়ার কুলিক নদী পার হওয়ার সময় অর্ধশতাধিক এলাকাবাসী নীলগাইটিকে আটক করে।

এ সময় নীলগাইটির সাথে ধস্তাধস্তিতে বুধু ও মকবুল আহত হন। পরে জাহিদের বাড়িতে যদুয়ার এলাকায় নিয়ে রাখা হয় নীলগাইটিকে। খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, রাণীশংকৈল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।

রানীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী আফরোজা বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নীলগাইটিকে যদুয়া এলাকা থেকে উদ্ধার করে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় উদ্যানে পাঠানো হয়েছে।’

ঠাকুরাগাঁও জেলা প্রশাসক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘নীলগাইটি এলাকাবাসী আটক করার সময় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঠাকুরগাঁওয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় উদ্ধারকৃত নীলগাইটি চিকিৎসার জন্য দিনাজপুর জাতীয় উদ্যানে পাঠানো হয়েছে। নীলগাইটি সুস্থ হলে পরবর্তীকালে সেটিকে কোথায় পাঠানো হবে তা বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, নীলগাইটি ৩-৪ মাস ধরে সদর উপজেলার রহিমানপুর পটুয়া এলাকায় বসবাস করছিল। স্থানীয়দের ধারণা নীলগাইটি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এলাবাসীর ফসল নষ্ট করায় সকলে মিলে অনেক চেষ্টা করেও কোনোভাবে নীলগাইটিকে আটক করতে পারেনি এলাকাবাসী। আটকের পরে এলাকার লোকজন নীলগাইটিকে নাড়াচাড়া করলে পেটে বাচ্চা আছে এমনটা বুঝতে পারে।

পরিবেশগত কারণের পাশাপাশি আমাদের দ্বারা বন-জঙ্গল ধ্বংস, জলাশয় ভরাট, আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস, শিকার ও পাচার, নির্বিচারে বন্যপ্রানী হত্যা ইত্যাদি নৃশংসতার কাছে হেরে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে না পেরে বাংলাদেশের অনেক প্রাণী পৃথিবীকে অকালে বিদায় জানিয়েছে। নীলগাই  এদের মধ্য অন্যতম।

 

Untitle-1
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নীলছে ধূসর বর্ণের হলেও স্ত্রী নীলগাই ও বাচ্চা লালচে বাদামী

 

২০১৬ সালের জুনের প্রথম দিকে     ফসল নষ্টের অজুহাতে হায়দরাবাদ থেকে ভাড়াটে শিকারি এনে ভারতের বিহার রাজ্যে মোকামায় আড়াইশোরও বেশি বিরল প্রজাতির নীলগাই হত্যার অভিযোগ উঠে। এই ঘটনা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তৎকালীন দেশটির নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মানেকা গান্ধী।

তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে মোকামায় জমি উর্বর হওয়ায় সেখানে ফসল ভাল হয়। সংলগ্ন জঙ্গল থেকে ফসল খাওয়ার লোভে প্রায়ই হানা দেয় বিরল প্রজাতির প্রাণী নীলগাই। কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় হায়দরাবাদ থেকে শিকারি এনে তিনদিন ধরে নীলগাইগুলিকে গুলি করে মারা হচ্ছিল। এ জন্য কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি জানাজানি হতেই দেশজুড়ে তৈরি হয় বিতর্ক।

প্রতিবাদী মানেকা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি বুঝতে পারেন না, বন্যপ্রাণীদের মেরে ফেলার ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এত রক্তলিপ্সা কেন। মানেকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, রাজ্য সরকারের আবেদনের ভিত্তিতেই নীল গাই হত্যার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, মানেকা পশুপ্রেমী হিসেবেই পরিচিত। সঞ্জয় গান্ধী অ্যানিমেল কেয়ার সেন্টারের প্রধান তিনি। সূত্র: এনডিটিভি।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তার আরণ্যক উপন্যাসে লিখেছেন-

‘কুন্ডিতে প্রায় নিঃশব্দে জল খাইতেছে একদিকে দুটি নীলগাই, অন্যদিকে দুটি হায়েনা, নীলগাই দুটি একবার হায়েনাদের দিকে চাহিতেছে, হায়েনারা একবার নীলগাই দুটির দিকে চাহিতেছে। আর দুদলের মাঝখানে দু-তিন মাস বয়সের এক ছোট নীলগাইয়ের বাচ্চা।”

একসময় এই নীলগাইয়ের কথা সাহিত্যিকদের লেখনিতে ফুটে উঠলেও এখন এর দেখা মেলেনা বাস্তব আর সাহিত্য দুটিতেই।

উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণের কর্ণাটক পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের নিম্ন বনভূমি এলাকা বিশেষ করে দিনাজপুর,ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মাঠ-প্রান্তর দাপিয়ে বেড়াতো নীলগাই। ১৯৫০ সালের পর হতে একে আর দেখা যায় না। এটি আমাদের দেশের একটি বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী।

নীলগাই দেখতে অবিকল বড় হরিণের মতো মনে হলেও চেহারার আদলে রয়েছে হরিণ-গরুর মাঝামাঝি মিল। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নীলছে ধূসর বর্ণের হলেও স্ত্রী নীলগাই ও বাচ্চা লালচে বাদামী। এদের দেহ লৌহধূসর লোমে আবৃত। দুইগালের পাশে থাকে সাদা দাগ। ঠোঁট,গলা,কানের ভেতর এবং লেজের তলায় সাদা বর্ণের দাগ থাকে। অল্পবয়সী নীলগাইয়ের বর্ণ অনেক সময় হলদেটে হয়। নীলগাই এর কাঁধ উঁচু, নিচু নিতম্ব; সামনের পায়ের চেয়ে পিছনের পা সামান্য ছোট। এদের গলার নিচে দুই ইঞ্চি পরিমাণ এক গোছা পশম থাকে,যা দেখতে খুবই সুন্দর। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অনেকটা একরকম মনে হলেও চেনার অন্যতম উপায় হচ্ছে শিং জোড়া,যা স্ত্রী নীলগাইয়ের নেই!

এরা হরিণের মতোই সামাজিক প্রাণী,বাস করে দলবদ্ধভাবে। প্রতিটি দলে ৫-১৫ টি নীলগাই থাকে।এরা গাছেঢাকা উঁচুনিচু সমতল বা তৃণভূমিতে যেমন স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে,তেমন আবার শস্যক্ষেত্রে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করতে পটু। সকালে আর বিকালে খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিনের বাকিটা সময় গাছের ছায়ায় কাটায়।

দলবদ্ধভাবে নীলগাই এর বসবাস : এরা পানি ছাড়া এরা দীর্ঘ সময় থাকতে পারে, এমনকি গ্রীষ্মকালে পানি পান না করে দু-চার দিন কাটিয়ে দিতে পারে। এদের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। বিপদে এদের আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হলো দৌড়ে পালানো। দ্রতগামী ও শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে না চড়ে নীলগাই ধরা প্রায় অসম্ভব। আরেকটি হাস্যকর স্বভাব হচ্ছে,এরা দলের সবাই মিলে মলত্যাগ করে একই স্থানে।

নীলগাই তৃণভোজী প্রাণী। প্রধান খাদ্য ঘাস। মহুয়া গাছের রসালো ফুল এদের দারুণ পছন্দ। তবে ডাল জাতীয় যেমন মাসকলাই,মসুর ও ছোলা নীলগাইয়ের খুব প্রিয়।

মাদি নীলগাই ২৫ মাস বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। গর্ভধারণের সময়কাল ৮ থেকে ৯ মাস। বাচ্চা প্রসব করে ১/২ টি। এদের গড়ায়ু ১৫-২০ বছর। কিন্তু সমস্যা হলো এই কয়েকটা বছর ও এরা নিরাপদে থাকতে পারে না। লোভাতুর শিকারীর দল নির্বিচারে নীলগাই নিধন করে এদের বংশপ্রদীপ নিভিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে চিড়িয়াখানা ছাড়া আমাদের দেশে কোথাও এর দেখা মেলে না। বলা যায়, নীলগাই বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।

 

গ্রন্থণা: শাহ মতিন টিপু

Print Friendly

Related Posts