বই, বইয়ের মেলা ॥ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১.
পৃথিবীতে যত মেলা হতে পারে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মেলা হচ্ছে বইমেলা। আমার ধারণা পৃথিবীতে যত বইমেলা আছে, তার মাঝে সবচেয়ে মধুর হচ্ছে আমাদের ফেব্রুয়ারী বইমেলা। কোনো কিছু না করে বইমেলার এক কোণায় চুপচাপ বসে থেকে শুধুমাত্র মেলার মানুষজনকে দেখে আমি আমার একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব!

মেলায় গুরুগম্ভীর বয়সী মানুষ যায়, কমবয়সী তরুণ তরুণী যায়, বাবা মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যায়, প্রত্যেকের ভাবভঙ্গী চালচলন আলাদা! কেউ বই কেনে, কেউ বই দেখে আবার কেউ শুধু ঘুরে বেড়ায়! এই অতি চমৎকার বইমেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয়েছে, আমি সিলেটে বসে আছি এবং লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করছি কবে বইমেলায় যাব!

গতবার বইমেলায় গিয়ে অবশ্যি আমার একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাচ্চাকাচ্চার জন্যে বই লিখি বলে আমাকে এক সময় প্রচুর অটোগ্রাফ দিতে হতো। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা বই নিয়ে ভীড় করে আসতো। এখনো ভীড় করে আসে। কিন্তু তাদের হাতে এখন প্রায় সময়েই কোনো বই নেই, তার বদলে আছে একটা স্মার্ট ফোন। সেই ফোন দিয়ে তারা সেলফি তুলতে থাকে। সেলফি বা ছবি তোলার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু বইমেলায় বইয়ের উপর অটোগ্রাফ না নিয়ে শুধু একটা সেলফি তুলে সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলে আমি একটু অস্বস্তি বোধ করি। এই সোশাল নেটওয়ার্ক বা ফেসবুকের যুগেও আমি সাংঘাতিকভাবে বইপন্থী মানুষ। যতই দিন যাচ্ছে আমি ততই বেশী বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে একটা মানুষকে পরিপূর্ণ হতে হলে তাকে অবশ্যই বই পড়তে হবে।

আমার ধারণা মানুষ আর পশুপাখির মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে মানুষ বিমূর্ত চিন্তা করতে পারে, পশুপাখি পারে না। যতরকম বিমূর্ত চিন্তা আছে তার মাঝে সবচেয়ে পরিচিত কার্যকর হচ্ছে বই পড়া। কাজেই কেউ যেন মনে না করে বই পড়াটি শুধু এক ধরনের বিনোদন, এটি তার থেকেও অনেক বড় একটি ব্যাপার। আমাদের একমাত্র সম্পদ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কটি। সেই মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় ব্যায়াম হতে পারে বই পড়া। মস্তিষ্ককে শাণিত করার এর থেকে কার্যকর আর কিছু হতে পারে না। সোশাল নেটওয়ার্ক জাতীয় আপদের প্রবল আক্রমণের সামনে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হতে পারে বই। তাই আমার মনে হয় রীতিমত যুদ্ধ করে হলেও আমাদের সবাইকে বইয়ের জগতে নিয়ে যেতে হবে। সেই জন্যে ফেব্রুয়ারীর বইমেলা দেখে আমি এতো উত্তেজিত হয়ে যাই।

২.
এবারের বইমেলায় আমার জন্য একটা অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটেছে। সেটা হচ্ছে, সায়েন্স ফিকশন ক্যাটাগরিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়েছে। দিন দশেক আগে আমি কোলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে খুব জাঁকজমক করে কোলকাতা লিট ফেস্টিভেল হয়। সেখান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পরাবাস্তব লেখার জন্যে। মঞ্চে আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পাশে বসেছিলোম। সেটি আমার জন্যে অনেক বড় একটি অভিজ্ঞতা। সেখানে আমার কাছ থেকে বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশান লেখালেখি নিয়ে জানতে চেয়েছিল। আমি অনেক জোর গলায় বলে এসেছি, বাংলাদেশের পাঠক নিশ্চয়ই সায়েন্স ফিকশান পড়তে খুব পছন্দ করে, কারণ আমাদের দেশে অনেক সায়েন্স ফিকশান লেখক। শুধু তাই নয় তারা একটা সোসাইটি করেছেন এবং বই মেলায় তারা র‌্যালী করে গিয়ে দলবেঁধে সব সদস্য একসাথে সায়েন্স ফিকশান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

তবে কলকাতার মানুষকে যেটা বলিনি, সেটা হচ্ছে দেশের সাহিত্যে মূলধারার মানুষেরা সায়েন্স ফিকশানকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। সবাই ধরেই নেয় সাহিত্যের কিছু সম্ভান্ত এলাকা আছে যারা সেই এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে পারে তারাই প্রকৃত সাহিত্যিক। অন্যেরা লেখক; দলীল লেখক কিংবা সায়েন্স ফিকশান লেখকের মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই। আজকাল অনেক রকম সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, প্রায় সবক্ষেত্রেই একজন প্রধান এবং একজন নবীন লেখক নেয়া হয়। নবীন লেখকদের বেলায় কখনো একজন সায়েন্স ফিকশান লেখককে বেছে নিতে দেখিনি। যদিও অনেকেই আছেন যারা খুব চমৎকার লেখেন।

এরকম একটা অবস্থায় যদি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা পুরস্কার সায়েন্স ফিকশান ক্যাটাগরিতে দেয়া হয়েছে তাহলে অবশ্যই আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে। মনে হচ্ছে সাহিত্যের জগৎটা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল, শুধুমাত্র সম্ভ্রান্ত কিছু মানুষ সেখানে যেতে পারতো, হঠাৎ করে কাঁটাতার তুলে দিয়ে সেখানে অন্যদেরকেও ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। সায়েন্স ফিকশান লেখক ঢুকেছেন, তাদের পিছু পিছু ভৌতিক গল্প লেখকরা ঢুকে যাবেন, তার পিছু পিছু রহস্য উপন্যাসের লেখক এবং সবার শেষে শিশু সাহিত্যিকেরা।

এই বছর সায়েন্স ফিকশানের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন মোশতাক আহমেদ, তাঁকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। চেনা মানুষ পুরস্কার পেলে আনন্দ বেশী হয়। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি- মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশদের অবদান নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘নক্ষত্রের রাজারবাগ’। মোশতাক আহমেদ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইটির মোড়ক উন্মোচন করে দিতে এবং আমি আনন্দের সাথে রাজী হয়েছিলাম। কোনো একটা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে মোশতাক আহমেদ জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেলেন এবং বইটির মোড়ক উন্মাচন করা হলো না। আমি সেদিনই ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছি।

পরদিন ভোরে আমি অফিসে গিয়েছি, গিয়ে দেখি মোশতাক আহমেদ আমার অফিসের সামনে অপেক্ষা করছেন তার হাতে রঙ্গিন কাগজে মোড়ানো একটি বই। আমাকে বললেন, বইটির মোড়ক উন্মোচন করানোর জন্যে তিনি রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট চলে এসেছেন। তিনি ঠিক করেছিলেন আমাকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করাবেন, কাজেই সেটি তিনি করে ছাড়বেন। আমি সব সময়েই দেখে এসেছি মোড়ক উন্মোচন হয় দশজনের সামনে, রীতিমত একটা আনন্দঘন অনুষ্ঠানে কিন্তু নক্ষত্রের রাজারবাগ মোড়ক উন্মোচনটি হলো আমার অফিসে। আমি আর মোশতাক আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। আমি মোড়কটি উন্মোচন করলাম, তিনি আমার হাতে বইটি তুলে দিয়ে তক্ষুণি ছুটলেন ঢাকা। আমার জীবনে এর চাইতে বিচিত্র মোড়ক উম্মোচন আর কখনো হয়নি, মনে হয় আর কখনো হবে না। ২০১২ সালে এই বইটি যখন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল তখন আমার চাইতে বেশি খুশি মনে হয় আর কেউ হয়নি।

৩.
আমি প্রতি বছরই ভাবি বইমেলায় আগে আমি কয়েকজন নুতন লেখকের বই নিয়ে কিছু লিখব। কিন্তু কখনো সেটি ঠিক করে করতে পারিনি। এই বছরও সেটি করা হলো কারণ মেলার আগে নুতন লেখকের বইগুলো খুঁজে পড়তে পারিনি। বইটি পড়া হয়নি, কিন্তু বইমেলায় গিয়ে যে বইটি কিনব বলে ঠিক করে রেখেছি, সেই বইটি নিয়ে দু একটি লাইন অন্তত লিখি।

দুই বছর আগে একজন মা আমাকে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছিল। তার শিশু সন্তানটি কোনো একটি রক্তজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য শোকে দিশেহারা হয়ে সেই মা শিশুটির শেষ কয়েকটি দিনের কথা লিখে আমাকে অনুরোধ করেছিল যদি সম্ভব হয় তাহলে আমি যেন এই ধরনের শিশুদের নিয়ে কিছু একটা লিখি।

একজন লেখক যখন কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখে সেটি পড়ে অনেক সময়েই আমরা ব্যাকুল হয়ে যাই। কখনো কখনো সেই কাল্পনিক চরিত্রের দুঃখ কষ্টে আমাদের চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু বই পড়া শেষ হলে, আমরা চোখ মুছে হাসি মুখে নিজের কাজে ফিরে যাই। কারণ আমরা জানি আমাদের দুঃখটি সত্যিকারের দুঃখ নয়; কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক।

কিন্তু একজন মা যখন তার শিশু সন্তানের জীবনের শেষ মুহুর্তের ঘটনাগুলো গভীর মমতা দিয়ে লিখে পাঠান সেটি পড়ে চোখ মুছে আবার হাসিমুখে নিজের কাজে ফিরে যাওয়া যায় না। কারণ চরিত্রগুলো কাল্পনিক নয়, বুকের ভেতর কোথায় জানি ব্যাথা টনটন করতে থাকে।

আমি এরকম মৃত্যুপথযাত্রী কিন্তু প্রাণোচ্ছ্বল হাসিখুশী একটি শিশুকে নিয়ে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তাই আমি ভাবছিলাম মা টিকে চিঠি লিখে বলব তোমার এই অচিন্ত্যনীয় কষ্টের কথাটুকু তুমি নিজেই কষ্ট করে লিখো। তোমার মত অন্য যারা আছে তারা হয়তো তোমার লেখাটি থেকেই সান্তনা পাবে। আমি তার সাথে যোগাযোগ করার আগেই সেই কমবয়সী মা আমাকে লিখে জানালো- বুকে পাথর বেঁধে কাহিনীটি লিখেছে। সে একা নয় তার মতো আরো যারা দুর্ভাগা মা রয়েছেন তারাও লিখেছেন। এই বইটি দিয়ে তারা এরকম অসহায় মাদের মাঝে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছেন, যেন শেষ মুহূর্তগুলোয় তাদের সন্তানেরা সত্যিকার চিকিৎসা পেতে পারে, সম্ভব হলে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।

বইমেলায় গিয়ে আমি বইটি কিনব। বইটির নাম ‘ওরা নেই নেই ওরা আছে’। শোকাতুর মায়ের নাম সায়মা সাফিক সুমী। প্রকাশকের নাম ‘সখী প্রকাশন’।

এই বছর বইমেলা গিয়ে আমি আরো একটি বই সংগ্রহ করব। কিন্তু আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত সেই বইটি আমি নেড়েচেড়ে দেখবো, চোখ বুলাব, কিন্তু পড়ার সাহস পাব না। বইটির নাম ‘বীরাঙ্গনা রচনাসমগ্র’, লেখিকার নাম সুরমা জাহিদ, প্রকাশকের নাম অন্বেষা। সুরমা জাহিদ এবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখার জন্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর চাইতে যথার্থ পুরস্কার আর কিছু হতে পারে কি না আমার জানা নেই।

সুরমা জাহিদের জন্ম ১৯৭০ সালে, একাত্তরে তিনি একজন অবোধ শিশু ছিলেন। তারপরও একাত্তর সালের বীরাঙ্গণাদের জন্যে তার ভেতরে এক ধরনের গভীর মমতা রয়েছে। সেই মমতা এবং ভালোবাসায় তিনি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সাতটি বই লিখেছেন। সেই বইগুলোকে সংকলিত করে পঞ্চান্নটি ভিন্ন ভিন্ন জেলার মোট ৩৬১ জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে ‘বীরাঙ্গনা রচনা সমগ্র’ বইটি দাঁড়া করিয়েছেন। একদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতার, অন্যদিকে নারীদের দুঃখ-কষ্ঠ এবং বেদনার ইতিহাসের এর চাইতে বড় কোনো দলীল আছে বলে আমার জানা নেই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধ কর্নার আছে। সেখানে আমরা সুরমা জাহিদের, বীরঙ্গনাদের উপর লেখা বইগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো ইতিহাস আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। কিন্তু তারপরও সুরমা জাহিদের লেখা এই বইগুলো আমি পড়তে পারি না। বুকের ভেতর এক ধরনের রক্তক্ষরণ হয়।

তারপরও আমি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের এই বইটি বইমেলা থেকে সংগ্রহ করব।

৫.
বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে লিখি। সেই হচ্ছে নুতন লেখক এবং তাদের প্রকাশিত বই।

আমি মোটেও জানতাম না যে, আমাদের বইমেলায় নুতন লেখকের যে বই প্রকাশ করেন- সেই বইগুলো তারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে ছাপান। বিষয়টি জানার পর আমি প্রকাশকদের সাথে কথা বলেছি, তারা আমাকে জানিয়েছেন বই মেলায় প্রকাশিত শতকরা সত্তর থেকে আশি ভাগ বই নাকি এরকম নিজের পকেটের টাকায় ছাপানো হয়। অন্যরা বলেছেন সংখ্যাটি নাকি আরো বড়।

যদি একজন লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে কোনো একজন প্রকাশককে দিয়ে তার বই বের করেন তাহলে সেই প্রকাশককে ‘প্রকাশক’ বলা যাবে না, তাকে ‘মুদ্রক’ বা এই ধরনের কিছু বলতে হবে। প্রকাশক তিনি, যিনি কোনো একজন লেখক গবেষকের কাজটুকু নিজের দায়িত্বে পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন। সেই কাজটুকু করার জন্য তার যদি অর্থের প্রয়োজন হয় সেই অর্থটুকু প্রকাশকের নিজের জোগাড় করতে হবে। যদি প্রকাশকের সেই অর্থ না তাকে তাহলে বুঝতে হবে প্রকাশকের বিষয়টি তার জন্যে নয় তাকে অন্য কোনো কাজ খুজেঁ নিতে হবে।

ঠিক একইভাবে নুতন লেখকের জন্যেও বলতে হবে, যদি কোনো লেখক নিজের পকেটের টাকা দিয়ে একটা বই প্রকাশ করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তার, বইটি এখনো প্রকাশের উপযোগী হয়ে উঠেনি। কেউ যদি সত্যি সত্যি লেখালেখি করতে চায় তাহলে তাকে কোনোভাবেই নিজের টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা চলবে না। এটি কি ধরণের অসম্মান! একজন সত্যিকারের লেখক কোনোভাবেই নিজেকে অসম্মানিত করতে পারে না।

নুতন লেখকদের সবসময়েই বলতে শোনা যায় তারা নুতন লেখক, বলে কেউ তাদের লেখা ছাপতে চায় না। এই অভিযোগটি অনেক পুরানো, মানিক বন্দোপাধ্যায় সেটি মানতে রাজী ছিলেন না। তার বন্ধুদের বলেছিলেন অভিযোগটি সত্যি নয়, ভালো লেখা হলেই ছাপা হবে। শুধু তাই না বন্ধুদের সাথে বাজী ধরে, একেবারেই অপরিচিত নুতন লেখক হিসেবে তিনি “অতসী মামী” নামে একটি গল্প লেখে সেই সময়কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে ছিলেন। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মত উদাহরণ আমাদের দেশেও অনেক আছে। সবচেয়ে বড় কথা এখন যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারা সবাই এক সময় নুতন লেখক ছিলেন, অপরিচিত লেখক ছিলেন। কাজেই নুতন লেখককে কেউ গুরুত্ব দেয় না সেই অভিযোগটি আমি শুনতে রাজী নই।

এখন ইন্টারনেট এবং ব্লগ আছে, কাজেই নুতন লেখকরা সেখানে লেখালেখি করতে পারেন। সেখানে বুঝতে পারবেন তার লেখালেখি কতোটুকু মানসম্মত হয়েছে। যদি লেখক হিসেবে তার একটা পরিচিতি হয় তখন প্রকাশকেরা আনন্দের সাথে তার বই ছাপতে রাজী হবেন।

আমি মনে করি প্রতিষ্ঠিত লেখক, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তাদেরকে সবসময় ভালো তরুণ লেখকের খোঁজ করতে হবে। যদি কাউকে খুঁজে পান তাকে দশজনের সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বইমেলায় এসেই যদি এই কাজটি করা যেতো তাহলে আরো ভালো হতো। নুতন ভালো লেখকেরা অনুপ্রেরণা পেতেন, উৎসাহ পেতেন।

আমাদের এতো সুন্দর একটা বইমেলা, সেটা শুধু বই ছাপানোর মাঝে আটকে থাকবে সেটা তো হতে পারে না। পাঠক-প্রকাশক-লেখক মিলে বইমেলার সত্যিকারের যে উদ্দেশ্য, সেটাকেও তো সত্যি করে তুলতে হবে।

 

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly

Related Posts