বিদ্রোহী, প্রেম আর শোষিতের কবি

 

আখতার-উজ-জামান

 

দুখু মিয়া ছিলেন একাধারে বিদ্রোহী কবি, তিনি প্রেমের কবি, তিনি শোষিতের কবি। নজরুলের বিশ্বাসের গভীরে ছিল ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’ আর সে কারণেই তিনি মানুষের বিভেদ সৃষ্টিকারী দেয়ালগুলো ভাঙতে চেয়েছিলেন।

 

তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুল তূর্যবাদকদের একজন নন তিনি ছিলেন সেই তূর্যবাদক দলের নায়ক। যিনি তার কবিতা ও গান দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিলেন বাঙালিকে। আবার কখনো অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

 

দুখু মিয়া চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আবৃত্তিকার, গায়ক, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও সংগঠক হিসেবে জড়িত ছিলেন ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত।

 

১৮৯৯ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত কাজী বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্রোহী, প্রেম আর শোষিতের কবি । স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম কাজী ফকির আহমেদ ও জাহিদা খাতুনের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন দুখু মিয়া। কাজী নজরুল ইসলামের দুই ভাই-কাজী সাহিবজান, কাজী আলী হুসেইন এবং একমাত্র বোন ছিলেন উম্মে কুলসুম। বাবা কাজী ফকির আহমেদকে বাল্যকালে হারান কাজী নজরুল।

 

আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটির কাজ করার সময় সেখানে দারোগা রফিজ উল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। তিনি কিশোর নজরুলকে নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। এভাবে দুখু মিয়া জীবনসংগ্রামে যুক্ত হন।

 

সময়টি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, বাংলা ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ, সাপ্তাহিক ‘বিজলী পত্রিকায়’ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পাঠক মহলে এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হলো একই সপ্তাহে। তার বাসনা ছিল সর্বদাই মানুষে মানুষে বিভেদ দূর করে এমন একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

 

‘মানুষ’ কবিতায় তিনি সেই চিরন্তন বাসনার কথা বলেছেন এভাবে: ‘গাহি সাম্যের গান-/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/ নাই দেশ-কাল পাত্রভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি’/ এই যে একটি চিরসত্য কথা নজরুল অবলীলায় বলেছেন, ‘অভেদ ধর্ম জাতি।’

 

কবি অন্নদা শংকর রায় নজরুলকে নিয়ে লিখেছেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সব কিছু/ভাগ হয়ে  গেছে/শুধু ভাগ হয়নি  কো/ নজরুল।’

 

বিদ্রোহী কবি’র বৈশিষ্ট্য তিনি রাজনীতিবিদ, মানবপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী, অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের রূপকার। তার কবিতা ও গান হৃদয় অনুরণনের ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের। তার কবিতা ও গান বিদ্রোহের। তার কবিতা ও গান অসাম্প্রদায়িকতার। তার কবিতা ও গান পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার। তার কবিতা ও গান মুক্তির।

 

কোলকাতায় পারিবারিক তত্ত্বাবধানে থাকা বাকরুদ্ধ এ কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা হয় নজরুল ইসলামকে। অভিসিক্ত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়। চিরবিদ্রোহী এ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

‘আজান’ কবিতায় চাওয়া শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় চির জাগরণের এ কবিকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন। ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার চেতনাকে কাজে লাগিয়ে সকল অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে দেশ ও জাতি, থাকবেনা কোনো বিভেদ, হানাহানি-এটাই আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।

 

azamanrahat@gmail.com

 

 

 

Print Friendly

Related Posts