ভারতের লোকসভায় রাহুল কান্ডে তোলপাড়

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ‘ঝাপ্পি’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে বেরোচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে তার জাপটে ধরার ছবি। আবার অভিনেত্রী প্রিয়া প্রকাশ ভারিয়ারের খোঁজ করলেও অষ্টাদশী সুন্দরীর মুখের পাশে তাঁর মুখ ফুটিয়ে তুলছে সার্চ ইঞ্জিন।

শুক্রবার গভীর রাতেও প্রায় একাই ইন্টারনেট শাসন করছেন রাহুল গান্ধী।  লোকসভায় কংগ্রেস সভাপতির কয়েকটা বিশেষ মুহূর্তই তার সঙ্গে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছে যাকে-তাকে বুকে জড়িয়ে ‘ঝাপ্পি’ দেওয়া মুন্নাভাই সঞ্জয় দত্ত এবং চোখের এক ইশারায় দেশজুড়ে তুফান-তোলা প্রিয়াকে।

প্রিয়া কিন্তু উচ্ছ্বসিত। বলেছেন, ‘‘কলেজ থেকে ফিরে দেখলাম, রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে চোখ টিপেছেন। খুব মিষ্টি লাগল। আমার প্রথম ছবির ‘সিগনেচার মুভ’টাকে নকল করেছেন উনি। আমি তাই খুব খুশি।’’ সাংসদদের অনেকেই অবশ্য জানিয়েছেন, মোদীকে নয়, পাশে বসা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে চোখ টিপেছিলেন রাহুল।

রবীন্দ্রনাথের গানের প্যারডি করছিলেন কেউ কেউ— ‘‘একটি আলিঙ্গনে, প্রভু, একটি আলিঙ্গনে!’’ আজ রাহুলের ‘হাগপ্লোম্যাসি’র (এই শব্দটিও রাতারাতি মাইক্রো-ব্লগিং ওয়েসাইটগুলির শিরোনামে) পরে ‘আলিঙ্গন বিনে গীত নাই’ কোথাও! শোভা দে যাকে বলেছেন ‘দশকের সেরা আলিঙ্গন’, শশী তারুর তারই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই বলে— ‘‘বিরোধীদের শ্বাস কেড়ে নেওয়া আলিঙ্গন, যার কোনও পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্য ছিল না।’’

‘ঝাপ্পি’ দেখে অনেকে মশকরা করেছেন যে, রাহুল নিশ্চয়ই ‘সঞ্জু’ দেখে এসে সংসদে ঢুকেছেন! অনুপম খেরের স্ত্রী, বিজেপি অভিনেত্রী-সাংসদ কিরণ খেরের কটাক্ষ, ‘‘রাহুল মোদীজীকে জড়িয়ে ধরে সংসদে নাটক করেছেন। এ বার আমরা তাকে বলিউডে পাঠিয়ে দেব!’’ খোঁচা অবশ্য মোদীও খেয়েছেন। লোকসভায় ঝোড়ো বক্তৃতা শেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আসনের সামনে গিয়ে রাহুল তাঁকে জড়িয়ে ধরার পরেই হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ছবি-সহ ‘মিম’। যার বক্তব্য, রাহুল কি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির মাপ নিতে গিয়েছিলেন? শোভা দে ফের টুইটারে লিখলেন, ‘এই ঘটনা প্রমাণ করল, জড়িয়ে ধরাটা প্রধানমন্ত্রীর একচেটিয়া নয়।’

বিজেপির রাম মাধব যদিও বলেছেন, ‘‘যা হয়েছে, তা জোর করে রাজনৈতিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা।’’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ কিছুটা ব্যাকফুটে গিয়েই যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘আলিঙ্গনকে তো সংসদ-বিরোধী বলা চলে না!’’ স্মৃতি ইরানির ব্যাখ্যা, বিপদে পড়লেই ‘ছোটরা’ বড়দের কাছে যায়! স্পিকার সুমিত্রা মহাজন অবশ্য ‘মাতৃস্নেহে’ একটু বকেছেন রাহুলকে।

গ্ল্যামার-দুনিয়া কাঁপিয়ে আসা তৃণমূল সাংসদ মুনমুন সেন কিন্তু এই ঘটনায় রাহুলের ‘রাজনৈতিক পৌরুষ’ দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মোদী বিদেশে অন্যদের জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু সেখানে তার মূল্য নেই। বরং অনেকে পছন্দ করেন না। এখানে কিন্তু জড়িয়ে ধরাটা হৃদয়ের উষ্ণতারই প্রকাশ।’’

উদ্দেশ্য-বিধেয় যা-ই থাক, আজ দিনটা নিঃসন্দেহে রাহুলেরই!

প্রসঙ্গত, শুক্রবার ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার মধ্যে ভাষণ শেষে রাহুল যা করলেন, তা ছিল তাক লাগানো। ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে সম্ভবত বিরলতম ঘটনা।

কংগ্রেসের পক্ষে রাহুলই ছিলেন প্রথম বক্তা। দুধসাদা কুর্তা পরে তাঁর ঠিক উল্টো দিকে বসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত চার বছরে মোদি সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনার মধ্যে রাহুল বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমার চোখে চোখ রাখতে পারছেন না। সম্ভবত তাঁর সংকোচ হচ্ছে। আমি জানি, আপনি আমাদের সহ্য করতে পারেন না। আমাকে পাপ্পু বলেন। ঘৃণা করেন। অনেক রাগ আমাদের ওপর। আমরা কিন্তু আপনাদের ওপর ক্ষিপ্ত নই। বরং আপনাদের ভালোবাসি। কৃতজ্ঞও। কারণ, প্রধানমন্ত্রীজি আপনি, আপনার দল বিজেপি এবং আরএসএস ভারতের আসল চরিত্র কী রকম তা আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে শিখিয়েছেন। আপনাদের মনে যে হিংসা রয়েছে, আমরা তা ভালোবাসায় পরিবর্তন করব। আমরা কংগ্রেস।’

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মোদি সরকারকে তুলোধোনা করে ভাষণ শেষে রাহুল নাটকীয়ভাবে গটগট করে ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে বাড়িয়ে দেন হাত। রাহুল দাঁড়িয়ে মোদির আসনের সামনে। প্রসারিত হাত ধরে ফেলেছেন মোদি। আচমকাই রাহুল প্রধানমন্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় গোটা কক্ষ হকচকিত। রাহুল ফিরে যাচ্ছেন তাঁর আসনের দিকে। মোদি তাঁকে কাছে ডাকলেন, হাত মিলিয়ে পিঠ চাপড়ে কিছু একটা বললেন। রাহুল ফিরে এলেন নিজের আসনে।

মাত্র কিছুদিন আগেই রাহুলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ক্ষমতা থাকলে লিখিত ভাষণ পাঠ না করে ১৫ মিনিট বক্তৃতা দিয়ে দেখান। সেটা করতে পারলে ভূমিকম্প দেখা দেবে। শুক্রবার লোকসভায় রাহুল সেটাই করে দেখালেন। তাঁর ভাষণের সময় শাসক দলের সমবেত বিরোধিতার মধ্য দিয়েও এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, আগামী নির্বাচনে কংগ্রেসই হতে চলেছে বিজেপির প্রবল প্রতিপক্ষ এবং মোদির লড়াইটা রাহুলেরই সঙ্গে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও তাই টুইট করে বললেন, বাস্তবিকই এটা পালাবদলের ভাষণ। ভূমিকম্প এসে গেছে।

খুশি সোনিয়া গান্ধীও। সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি খুব খুশি। আরও খুশি প্রচারমাধ্যমের মনোভাব বদলাচ্ছে দেখে।’

Print Friendly

Related Posts