মিস্টার বাংলাদেশ : জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘প্রথম’ সেলুলয়েড যুদ্ধ

সাইফুল আহমেদ : খিজির হায়াত খান প্রযোজিত ও মূল ভূমিকায় অভিনীত সিনেমা ‘মিস্টার বাংলাদেশ’। বিষয়বস্তু জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।

বাংলাদেশে গত পাঁচ/ছয় বছর ধরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদ সরকার কঠোর হস্তে দমন করেছে এবং করছে। তবে এ নিয়ে সিনেমা খুব একটা হয়নি। এর আগে দীপংকর দীপনের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমায় সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পুলিশি লড়াই উঠে এসেছে। যেখানে একজন সাইকো কীভাবে দেশে নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে তা উঠে এসেছে। তবে ঠিক জঙ্গিবাদ ও তার বিরুদ্ধে লড়াই কখনো উঠে আসেনি। সে দিক থেকে ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সেলুলয়েড যুদ্ধ, বলা যায়।

জঙ্গিবাদ নিয়ে সিনেমা করা এতটা সহজ বিষয় না। এ নিয়ে কাজ করতে গেলে অজানা এক আতঙ্ক মনের কোণে বাসা বাঁধে। আসতে পারে নানা হুমকি-ধামকি। সেসব মাথায় রেখে অনেকেই এ ছবি থেকে পিছপা হয়েছেন। তবে এ নিয়ে কাজ করে খিজির হায়াত খান নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

সিনেমার সংক্ষিপ্ত কাহিনী হলো- এক গোয়েন্দা এজেন্ট হরতাল চলাকালীন তার স্ত্রী-কন্যাসহ বাবার বাড়ি কুমিল্লা থেকে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বাস থামলে তিনি স্ত্রী-কন্যাকে বাসে রেখে খাবার কিনতে বাইরে বের হন। এমন সময় দুর্বৃত্তরা পেট্রোল বোমা হামলা চালায় বাসটিতে। ওই গোয়েন্দার স্ত্রী-কন্যাসহ বাস যাত্রীরা নিহত হন এ হামলায়। হতাশ সাফায়েত নামের ওই গোয়েন্দা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধ নিতে মনস্থির করেন। তিনি ইব্রাহিম নাম ধারণ করে একটি সংবাদপত্রের ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পেট্রোল বোমা হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে দেখেন, এ হামলার পেছনে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক চক্র, যাদের মূল লক্ষ্য দেশে জঙ্গিবাদ কায়েম করা, দেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এ জন্য ওই চক্রটি বেছে নেয় ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে। আর্থিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত যুবকদের ব্যবহার করতে শুরু করে মাহমুদ নামের এক অর্থলোভী জঙ্গি এজেন্ট। স্ত্রী-কন্যার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শুরু হয়ে সাফায়েতের মিশন। ‘একজনের প্রতিশোধ’ পরিণত হয় ‘দেশের প্রতিবাদে’। প্রকৃতার্থেই একজন পরিবারহারা মানুষের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ হয়ে উঠার গল্প এটি।

mr-bangla-1

সিনেমায় পরিচালক আবু আক্তারুল ইমন খুব নিপুণভাবে জঙ্গিবাদের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে এই চিত্রায়নে যিনি জীবন দান করেছেন তিনি খিজির হায়াত খান। বলা যায়, সিনেমাটি একাই টেনে নিয়ে গেছেন তিনি।

অধিকাংশ বাংলা সিনেমায় একটি সমস্যা লক্ষণীয়। তা হলো- সিনেমার গল্প ‘প্রেডিক্টিবল’। মাঝপথে গিয়ে দর্শক সিনেমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে এক্ষেত্রে উত্তীর্ণ ‘মিস্টার বাংলাদেশ’। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিণতি দেখার আশায় দর্শকদের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত চুম্বকের মতো টেনে ধরে রাখে এই সিনেমার কাহিনী।

সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খাপসই। খিজির-শানু ভালোবাসার ‍মুহূর্তগুলো যেমন চমৎকার রোমান্টিক আবহে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে রয়েছে ভরপুর উত্তেজনা।

সিনেমায় মিস্টার বাংলাদেশ চরিত্রে অনবদ্য খিজির হায়াত খান। ক্যারিয়ারের (‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ ও ‘জাগো’ এর পর) মাত্র তৃতীয় সিনেমা হিসেবে অনেক বেশি পরিণত তিনি। সিনেমায় তার শত ভাগ দেওয়ার প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় স্পষ্ট।

খিজিরের স্ত্রীর ভূমিকায় জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে চমৎকার সাবলীল অভিনয় করেছেন সাবেক লাক্স তারকা সানারেই দেবী সানু। এ ছাড়া টাইগার রবি, শামীম হাসান সরকার, ম্যারিয়েল পেলেগ্রীনের অভিনয়ও মন কাড়ার মতো। তবে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সোলায়মান সুখনকে কেমন যেন বেমানান মনে হয়েছে। হয়তো এখানে বয়সের ব্যাপারটা খানিকটা ভূমিকা রেখেছে। নাট্য অভিনেতা সাইফ আজাদ এ সিনেমায় আছেন সংক্ষিপ্ত চরিত্রে। তবে ‘উঠন্ত মুলো পত্তনে চেনা যায়’। সিনেমায় তার অভিনয় সেটিই প্রমাণ করে যে, আগামীতে বড় অভিনেতাই হতে যাচ্ছেন তিনি।

‘মিস্টার বাংলাদেশ’ এর সিনেমাটোগ্রাফি, কোরিওগ্রাফি, কাহিনী মোহনীয়। সিনেমায় শামুকের মতো দুটি খোলস। এর একাংশ নাচ-গান, রোমান্সে ভরপুর, অন্যটি অ্যাকশনে। আর দুই খোলসের মাঝখানে রয়েছে হীরের মতো জ্বলজ্বল জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রোমাঞ্চকর কাহিনী। সিনেমায় নাচ-গান, রোমান্স আছে; তবে নেই কোনো আপত্তিকর দৃশ্য। সম্পূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে উপভোগ্য সামাজিক চলচ্চিত্র।

পরিশেষে বলা যায়, এটি এমন একটি সিনেমা যা যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে জঙ্গিবাদ প্রত্যাখান করে মিস্টার বাংলাদেশ হয়ে ‍উঠতে।

Print Friendly

Related Posts