শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ‘শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়ন: এসওএস শিশু পল্লীর ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বক্তারা। তারা বলেন, এসওএস শিশুপল্লীর কার্যক্রম সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের সুন্দর জীবন গড়তে বিশ্বজুড়েই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একে মডেল ধরে সারাদেশেই শিশুপল্লী গড়ে তোলা হলে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া শিশুরা আলোকিত জীবনের দেখা পেতে পারে।

এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী বাংলাদেশ ও ইত্তেফাক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে তাদের এই দৃষ্টান্তমূলক কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কথাও উল্লেখ করেন বক্তারা।

রবিবার (১৪ অক্টোবর) কাওরান বাজারের ইত্তেফাক কার্যালয়ে মজিদা বেগম মিলনায়তনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিশেষ অতিথি ছিলেন বরিশাল -৫ আসনের সংসদ সদস্য জেবুন্নেসা আফরোজ ও মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম। এতে সূচনা বক্তব্য রাখেন এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর গোলাম আহমেদ ইসহাক। ‘শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়ন: এসওএস শিশু পল্লীর ভূমিকা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক ন্যাশনাল ফোকাল পারসন চায়না রানী সাহা। সভাপতিত্ব করেন ইত্তেফাকের সিটি এডিটর আবুল খায়ের।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক ছড়াকার আনজীর লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান, শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান ড. খাজা শামসুল হুদা, ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেড়ীন, সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাপক মোঃ একরামুল কবীর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী আবদুল্লা আল মামুন, এসওএস আন্তর্জাতিক শিশু পল্লী বাংলাদেশের জাতীয় উপপরিচালক ডা. মোঃ এনামুল হক, ব্যারিস্টার মিতি সানজানা, কবি ও গণমাধ্যম কর্মী তাহমিনা শিল্পী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ পরিচালক এম. রবিউল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক আসিফুর রহমান সাগর।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থতিতে শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেই কাজে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে আইন প্রণয়ণে এবং তা বাস্তবায়নে আমাদের অগ্রগতি ভালো। সারাদেশে শিশু আদালত বসানো হচ্ছে। যা আলাদাভাবে শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে। এর পাশাপাশি, দেশের প্রতিটি বিভাগে ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শেখ রাসেল দুঃস্থ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে এতিমখানার ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তাদের দেশের প্রচলিত সাধারন শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে নীতিমালা করা হচ্ছে।

সংসদ সদস্য জেবুন্নেসা আফরোজ বলেন, শিশুরাই আগামি ভবিষ্যত। সবাই শিশু সুরক্ষাই নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেন। তবে সরকার শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়নে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এবারের বাজেটে শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ রেখেছে সরকার। তবে, শিশুদের সুরক্ষায় মাকে ভুলে গেলে চলবে না। মায়ের কথাও ভাবতে হবে। সরকার সে কথা ভাবে। শিশুদের সুরক্ষায় মায়েদের গর্ভবতী অবস্থা থেকে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা হয়। শিশুর জন্মের আগে থেকে এবং জন্মের পর টিকা প্রদান থেকে শুরু করে তাদের শিক্ষা, বিনামূল্যে বই প্রদানসহ শিশুদের উন্নয়নে সবকিছুই সরকার করছে। সেবামূলক সংগঠন ও এনজিওরাও কাজ করছে। তবে সবকিছু সরকার একা করতে পারবে না। শিশুদের সুরক্ষায় সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে।

নাছিমা বেগম বলেন, এসওএস শিশুপল্লী অবহেলিত বঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। তারা আগামির কারিগর। তাই শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার বিষয়টি শুধু মহিলা ও শিশু এবং সমাজকর‌্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এর জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, এদের মধ্যে যারা সুবিধাবঞ্চিত শিশু তাদের সুরক্ষায় সরকারের নানামুখী কর্মসূচি রয়েছে। সব মায়েরা যাতে কর্মজীবী হতে পারে সেজন্য সরকার ডে কেয়ার সেন্টার চালু করতে আইন প্রণয়ন করছে। এতে নিম্নবিত্ত ও অভাবী মায়েরা যাতে সন্তানকে বিনামূল্যে ডে কেয়ার সেন্টারে রাখতে পারে সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। স্বল্প আয়ের মায়েরা যাতে অল্পকিছু খরচ দিয়ে ডে কেয়ার সেন্টারে রাখতে পারে সে ব্যবস্থা হচ্ছে।

স্বাগত বক্তব্যে শিশুপল্লীর ন্যাশনাল ডিরেক্টর গোলাম আহমেদ ফারুক বলেন, এসওএস শিশুপল্লীর মাধ্যমে সমাজের যেসব শিশু অন্ধকার জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ায় তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে কাজ করে। শিক্ষা, বাসস্থান ও উন্নত জীবনবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সারাবিশ্বে অনন্য মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এসওএস শিশুপল্লী। বিশ্বজুড়ে এসওএস শিশুপল্লী শিশু অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত। বিশ্বের অসংখ্য দেশে এখন এসওএস শিশুপল্লী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এই শিশুপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা হারম্যান মেইনার। এর বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে দেশের ছয়টি স্থানে এসওএস শিশুপল্লী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। এদের মধ্যে সব সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে সুন্দর জীবন নিশ্চিত করা যায় নি। তবে, শিশুপল্লীর এ মডেলটি অনুসরণ করে দেশজুড়ে শিশুপল্লী গড়ে তুললে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

মূল প্রবন্ধে চায়না রানী সাহা বলেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরেও শিশু অধিকার লংঘন ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ শিশু নির্যাতন ও শিশু অধিকার লংঘন বেড়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারও এসওএস শিশুপল্লী বাংলাদেশ এর শিশু যত্ন মডেলকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। এর আওতায় সরকারের সকল শিশুসদন এবং বেবিহোমগুলোকে পর্যায়ক্রমে শিশুপল্লীর আদলে পরিচালিত হবে। তারপরেও ‘শিশু অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠা করে সব মন্ত্রণালয়ের শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে সমন্বয়ের প্রতি তাগিদ দেন তিনি।

ডিআইজি ব্যারিস্টার মাহবুব হোসেন বলেন, নারী ও শিশু সুরক্ষায় সরকারের অত্যন্ত কার্যকরী আইন রয়েছে। তারপরেও শিশু নারী নির্যাতনের, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের কাছে থাকা তথ্য-উপাত্ত মতে, পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন আশংকাজনক হারে বেড়েছে। ছেলে-মেয়ে উভয়ের আত্মহত্যা প্রবণতাও বেড়েছে। ডিভোর্সের মাত্রা বেড়ে গেছে। এসব তথ্য প্রমাণ করে আমাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে। পুলিশ অপরাধীকে গ্রেফতার করে। অপরাধ ঘটার পরে। তাদের শাস্তির জন্য আদালতে পাঠায়। কিন্তু পরিবারের মধ্যে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়াতে হবে। তাই অপরাধ দমনে সাধারন মানুষের সহযোগিতা তাদের সামাজিক অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

আবুল খায়ের বলেন, দেশ উন্নত হচ্ছে। এর সঙ্গে অপরাধ বাড়বে। সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে। এসবের মাঝেই আমাদের শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। সরকার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও দেশের জনগণকে একসঙ্গে সমিন্বতভাবে এই সমস্যা মোকাবেলায় একযোগে কাজ করতে হবে।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শরণার্থী ও পরিবার হারানো শিশুদের হারম্যান মেইনার শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘এসওএস শিশু পল্লী’র ধারণাটি চালু করেন। যা পরিবার ও মা-বাবা হারানো ওই শিশুগুলির কাছে পরিবারের বিকল্প হয়ে তাদের ভবিষ্যত জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সেই থেকে এতিম এবং মাতা-পিতার স্নেহবঞ্চিত শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে তাদের যে কার্য পদ্ধতি তা বিশ্বে শিশু সুরক্ষায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

Print Friendly

Related Posts