সব পুলিশ এমন হলে বদলে যেত বাংলাদেশ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সেদিন শবনম আক্তার পপির কল সাইন ছিল ‘এপোলো-সিক্স-ওয়ান’। টহল দিচ্ছেন মহাখালি এলাকায়। রুটিন ডিউটি। হঠাৎ ওয়্যারলেসে বার্তা এলো। মহাখালিতে এক্সিডেন্ট হয়েছে। এখনই ছুটতে হবে। গাড়ি ছুটলো মহাখালির দিকে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন ভয়াবহ পরিস্থিতি। অনেক কটি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। রাস্তায় উল্টে আছে গাড়ি। পথ বন্ধ। বিরাট বিশৃঙ্খলা।

“ভিআইপি পরিবহনের বাসটি যখন ফাইওভার থেকে নীচে নামছিল, তখন সেটি ব্রেক ফেল করে সামনের গাড়িতে ধাক্কা মারে। ধাক্কাটা আসলে জোরে-শোরেই ছিল। পরপর দশটি গাড়িতে ধাক্কা লাগে। একটা পিক-আপ ভ্যান উল্টে একজন মারাত্মকভাবে আহত। কয়েকজন মোটর বাইক আরোহীও আহত হয়েছেন,” বলেন তিনি।

দিনটি ছিল ২২ এপ্রিল, রবিবার। সেদিন পুলিশের উপ-পরিদর্শক শবনম আক্তার পপি এরপর যা যা করেছিলেন, সেটিকে তিনি ভেবেছিলেন পুলিশ হিসেবে তাঁর কর্তব্য। কাজের অংশ।
কিন্তু যারা সেদিন ঘটনাটি দেখেছেন, ছবি তুলেছেন এবং সেই ঘটনার কাহিনী এবং ছবি অনলাইনে শেয়ার করেছেন, তাদের কাছে এটি ছিল বিরল এবং অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী যেখানে প্রতিদিন নানা কাজের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে, কিছু পুলিশ সদস্যদের নানা কান্ড-কীর্তির কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, সেখানে শবনম আক্তার পপিকে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আদর্শ’ বা ‘রোল মডেল’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

কী ঘটেছিল সেদিন: শবনম আক্তার পপি বলেন, ঘটনার গুরুত্ব বুঝে আমি কাছাকাছি আরও যে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন তাদের সাহায্য চাইলাম। ভিআইপি পরিবহনের গাড়িটা বিকল হয়ে পড়ে ছিল একেবারে মাঝ রাস্তায়। এর ফলে সেখানে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। গাড়িটার ব্রেক ফেল করেছিল। কাজেই কিভাবে গাড়িটা সরানো যায়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নিজেই গাড়িটা চালিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেব।

আমার মনে হয়েছিল তখন যদি আমি দ্রুত গাড়িটা রাস্তা থেকে সরিয়ে না নেই, তাহলে আমার ডিপার্টমেন্টের বদনাম হবে। আর আমার ডিপার্টমেন্ট এই ট্রেনিংটাই দেয় মানুষের সেবা করা, বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করা। আমাদের কিন্তু ট্রেনিং এ এটাই শেখানো হয়।”

শবনম আক্তার পপি গাড়ি চালানো শিখেছিলেন নিজের আগ্রহেই। পরে পুলিশ সদস্য হিসেবেও গাড়ি চালানোর প্রশিণ নেন। কাজেই বাসটি চালিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি। তবে কিছুটা ভয় কাজ করছিল, যেহেতু বাসটির ব্রেক কাজ করছিল না।

যে পিক-আপটি রাস্তায় উল্টে গিয়েছিল, তার ড্রাইভার আহত হয়ে পড়েছিলেন রাস্তায়। ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন। তাকে ফার্ষ্ট এইড দেয়ার কাজেও এগিয়ে গেলেন শবনম আক্তার পপি।
বললেন, “তার অবস্থা দেখে আমার বেশ খারাপ লাগছিল। তখন আমি একজনকে টাকা দিয়ে বললাম, আমাকে কিছু বরফের টুকরো এনে দিন। আমি আহত লোকটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম এই বলে যে আপনার কিছুই হয়নি। আমি পরে তার আঘাতের জায়গাগুলিতে বরফের সেঁক দেই। ”

“লোকটি বলছিল তার পা বোধহয় ভেঙ্গে গেছে। তখন আমি গামছা দিয়ে সেখানটা বেঁধে দেই। তখন আমার মনে হচ্ছিল, যদি আমি সেই সময়ে এই প্রাথমিক চিকিৎসটা না দেই, এই পা হয়তো আর ভালোই হবে না।

আহত লোকটিতে এরপর দাঁড়াতে সাহায্য করেন তিনি, হাঁটতে সাহায্য করেন। তারপর একটি গাড়িকে অনুরোধ করে লোকটিকে বাড়িতে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
পুলিশ সদস্য হিসেবে ফার্ষ্ট এইডের প্রশিণও নিয়েছিলেন শবনম আক্তার পপি। তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের এখন এসব প্রশিণ দেয়া হয়। তাঁর ভাষায়, “বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেক এগিয়ে। আমাদের ড্রাইভিং, ফার্ষ্ট এইড- সব কিছুই শেখানো হয়।”

গত কয়েকদিন ধরেই যেখানে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার কান্ড-কীর্তি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে, সেই পটভূমিতে শবনম আক্তার পপির এই ভূমিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। এই ঘটনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন অনেকে। সেদিন আহত এক মানুষকে তাঁর ফার্স্ট এইড দেয়ার ঘটনার ছবির নীচে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গুলশান অঞ্চলের ডেপুটি কমিশনার মোস্তাক আহমেদ নিজেও এ নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজন পথচারীর পায়ের শুশ্রুষা করছেন একজন পুলিশ সদস্য। এই ছবি শুধু পুলিশের সেবার কথা বলে না, পরিবর্তনের কথাও বলে। শ্রদ্ধা।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে এই শোরগোল কেমন লাগছে শবনম আক্তার পপির? এটিকে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন তিনি। বলেন, “আমার স্যার আমাকে নিয়ে ফেসবুকে যে পোস্টটি দিয়েছেন, সেটি আমার অন্তর ছুঁয়ে গেছে।”

বিবিসি

Print Friendly

Related Posts