সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের জীবনাবসান

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম আর নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য রোববার বিকেলে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান জানান, বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তরিকুল ইসলাম।  মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন।

দীর্ঘদিন ধরে তরিকুল ইসলাম ফুসফুসে সংক্রমণ, কিডনি জটিলতাসহ নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও অনুসারী রেখে গেছেন।

তরিকুল ইসলামের ভাতিজা ও যশোর নগর বিএনপির সভাপতি মারুফুল ইসলাম জানান, কিডনি সমস্যার কারণে তাঁকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস দিতে হতো। আজ ডায়ালাইসিস দেওয়ার সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। দুপুরের দিকে চিকিৎসকরা জানান, ডায়ালাইসিস দেওয়ার সময় তাঁর ‘হার্ট অ্যারেস্ট’ হয়। বেলা দেড়টার দিকে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। বিকেল ৫টার কিছুসময় পর তিনি মারা যান।

প্রথম জানাজা নয়াপল্টনে

বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের জানাজা আগামীকাল সোমবার সকাল ১০টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর সোয়া ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণপ্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় জানাজা। বিকেলে যশোর ঈদগাহ মাঠে বিকেল ৪টায় তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাঁকে।

আজ সন্ধ্যায় তরিকুলের মরদেহ তাঁর শান্তিনগরের বাসভবনে নেওয়া হয়।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন

১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরের বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তরিকুল ছাত্রজীবনেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য তিনি নয় মাস কারাবন্দি ছিলেন। ৬৯-এর গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য আবারও কারাবন্দি হন।

১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সালে তিনি যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি একই পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যোগদানের পর তিনি যশোর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং একইসঙ্গে তিনি দলটির জেলা আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। একই বছর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর তরিকুল ইসলামকে আটক করা হয়। তিন মাস অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন করা হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালে তরিকুল ইসলাম সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং পরের বছর একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। এ সময় তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি এ মন্ত্রণালয়েরও পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।

২০০১ সালে নির্বাচনে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি যশোরের রাজনীতিতে এবং এলাকার উন্নয়নে তরিকুল ইসলাম অসামান্য অবদান রেখে গেছেন- এ কথা তাঁর কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ যেমন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিককে হারাল, তেমনি যশোরেও তৈরি হলো একটি বড় শূন্যতা।

Print Friendly

Related Posts