২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে গেল বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের নতুন যাত্রা

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোররাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহটির যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মহাকাশ পানে যাত্রা শুরুর কথা ছিল। সব প্রস্তুতি সেরে উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল; কিন্তু মিনিট খানেক আগে সমস্যা দেখা দেওয়ায় স্যাটেলাইটটি আর ওড়েনি লঞ্চ প্যাড থেকে।

কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, উৎক্ষেপণের ঠিক দুই মিনিট আগে এটি কম্পিউটারের কন্ট্রোলে চলে যায়। হয়ত কিছু সমস্যায় আপাতত উৎক্ষেপণ স্থগিত করা হয়েছে। আগামীকাল ঠিক একই সময় পুনরায় উৎক্ষেপণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। তারানা হালিমও বলেন, আগামীকাল একই সময়ে উৎক্ষেপণের ক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। রয়টার্স বলেছে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণটি ২৪ ঘণ্টার মতো পিছিয়ে যাচ্ছে। কী সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা চিহ্নিত করা যায়নি।

উৎক্ষেপণ দেখতে কেনেডি স্পেস সেন্টারে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জয় তার ফেইসবুকে লিখেছেন, উৎক্ষেপণের শেষ মিনিট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে। কম্পিউটারের হিসাবে কোনো কিছু স্বাভাবিকের বাইরে ধরা পড়লে তা উৎক্ষেপণ কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। আজকে উৎক্ষেপণের মাত্র ৪২ সেকেন্ড আগে তা বন্ধ করে দেয়। স্পেসএক্স আবার সব কিছু পরীক্ষা করবে এবং আগামীকাল একই সময়ে আবার উৎক্ষেপণের চেষ্টা করবে।

রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেওয়া হয় না, তাই এ রকম হওয়াটা ‘খুবই স্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন জয়।

ফরাসি প্রতিষ্ঠান তালিস এলিনিয়া স্পেসের তৈরি বাংলাদেশের জাতির জনকের নামাঙ্কিত এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের মাধ্যমে। স্পেসএক্স তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ থেকে ৪টা ২১ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের নতুন সময় ঠিক করা হয়েছে।

কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড ৩৯ এ থেকে এটি উৎক্ষেপণ হচ্ছে, এই প্যাড থেকেই মানুষকে নিয়ে চাঁদে রওনা হয়েছিল চন্দ্রযান অ্যাপোলো-১১।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে  সরাসরি দেখতে ভোররাতেও অনেকের চোখ ছিল মনিটরে, অনেকে ছিলেন টেলিভিশনের সামনে।

লঞ্চ প্যাড থেকে উৎক্ষেপণের পরপরই স্টেজ-১ চালু হয়ে রকেটটির উপরের দিকে উঠতে শুরু করার কথা ছিল প্রচণ্ড শক্তিতে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রকেটের স্টেজ-১ খুলে নিচের দিকে নামার কথা ছিল। এরপর চালু হওয়ার কথা ছিল স্টেজ-২ এর। ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যেত। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ এর পৃথিবীতে ফেরার কথা, আর স্টেজ-২ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত স্যাটেলাইটকে নিয়ে গিয়ে মহাকাশেই থেকে যাওয়ার কথা।

কিন্তু দেখা গেছে, উৎক্ষেপণের আগেই থেমে যায় কার্যক্রম; ফলে টিভি কিংবা কম্পিউটারে রাত জেগে থাকা মানুষগুলোকে কিছুটা হতাশ হতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মহাকাশে পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে লাগবে প্রায় এক মাস। এরপর কারিগরি বিভিন্ন বিষয় শেষ করে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসতে আরও এক মাস সময় লাগবে বলে ধারণা বিটিআরসির।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় নির্মিত হয়েছে গ্রাউন্ড স্টেশন।

স্যাটেলাইট মহাকাশে উন্মুক্ত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে।

প্রকল্প পরিচালক মো. মেজবাহুজ্জামান বলেছেন, এই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট) স্থাপন করা হবে। স্যাটেলাইটটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর হতে আরও এক মাস সময় লেগে যাবে।

বাংলাদেশ এতদিন বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া করে সম্প্রচার ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে আসছিল; বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বাংলাদেশকে গুণতে হয় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাই ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিজস্ব যোগাযোগ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর  বাংলাদেশ ভাড়ার নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে বলে সরকার আশা করছে।

এর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ব্র্যাক অন্বেষা নামে একটি ন্যানো স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। তা ছিল মাত্র এক কেজি ওজনের। বিপরীতে বঙ্গবন্ধু-১ এর উৎক্ষেপণ ভর তিন হাজার ৫০০ কেজি।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলক এক নিবন্ধে বলেছেন, এই যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মূলত তিন ধরনের সেবা পাওয়া সম্ভব। এগুলো হল- সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ ও ডেটা কমিউনিকেশন। বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব টেলিভিশন চ্যানেল এবং রেডিও চালু রয়েছে, সেসব মূলত অন্য কোনো দেশের স্যাটেলাইটে নির্ভর করে সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানের কাছে স্যাটেলাইট সেবা দিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খলিলুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ইন্দোনেশিয়ার একদম উপরে। ইন্দোনেশিয়ার পেছন দিকে পুরোটাই সমুদ্র। ইন্দোনেশিয়া থেকে সামনের দিকে যত দেশ আছে যেমন মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর সবই কিন্তু আমাদের কাভারেজে আছে।

বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহের মালিকদের ‘এলিট ক্লাবে’ নাম লেখানোর প্রত্যাশায় রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিমন্ত্রী পলক বলেছেন, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ৫৭তম রাষ্ট্র হবে।

এই যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এক দশক আগে। এরপর উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক সভায় ২ হাজার  ৯৬৮ কোটি টাকার ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’ প্রকল্প অনুমোদন পায়।

এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া ‘বিডার্স ফাইন্যান্সিং’ এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

এই প্রেক্ষিতে হংক সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সঙ্গে প্রায় একহাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

স্যাটেলাইট সিস্টেমের নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’। এরপর স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের কোম্পানি তালিস এলিনিয়া স্পেসের সঙ্গে একহাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি।

পৃথিবীর কক্ষপথে একটি স্যাটেলাইট বসাতে প্রয়োজন হয় সুনির্দিষ্ট অরবিটাল স্লট। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে এই অরবিটাল স্লট ইজারা নিতে অনুমোদন দেওয়া হয় ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মাঝে স্যাটেলাইটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। মহাকাশে স্যাটেলাইটের কার্যকারিতার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকাল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মিশনের মেয়াদকাল হবে ১৫ বছর।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মিত হয়েছে ফ্রান্সের তালিস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিতে। নির্মাণ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা ও হস্তান্তর শেষে বিশেষ কার্গো বিমানে করে সেটি ফ্লোরিডার কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চ সাইটে পাঠানো হয়।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রথমে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ ঠিক করা হলেও হারিকেন আরমায় ফ্লোরিডায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় তা পিছিয়ে যায়। এরপর ৪ মে উৎক্ষেপণের সম্ভাব্য তারিখ রাখা হয়। কিন্তু এপ্রিলের শেষে এক অনুষ্ঠানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানান, উৎক্ষেপণ পিছিয়ে গেছে অন্তত ৭ মে পর্যন্ত।

আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় সেই তারিখ আবার পিছিয়ে ১০ মে ঠিক হয়। প্রথমে রাত ২টা ৪৭ (বাংলাদেশ সময়) মিনিট ঠিক হলেও পরে তা এক ঘণ্টা পিছিয়ে যায়। কিন্তু পুনর্নির্ধারিতক সময়েও উৎক্ষেপণ হল না।

 

Print Friendly

Related Posts