স্নিগ্ধা-কামরুল যেভাবে পরকীয়ায়

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বাবুসোনার স্ত্রী দিপা ভৌমিক স্নিগ্ধা ও তার প্রেমিক কামরুল মিলে অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনাকে খুনের ঘটনায় বিস্মিত-হতবাক রংপুরের মানুষ। সর্বত্র ক্ষোভ-ধিক্কার। দু’ জন দু’ ধর্মের। পরিবার-সন্তান রয়েছে দু’ জনেরই। পরকীয়ায় ভেঙে চুরমার দুটি সাজানো সংসার।

দু’ জনই দীর্ঘকাল ধরে চাকরি করতেন তাজহাট উচ্চ   বিদ্যালয়ে। গতকাল সে স্কুলে গিয়ে দেখা যায় এক অন্যরকম পরিবেশ। স্কুলের শিক্ষিকা ফেরদৌসী আরা পলি বলেন, যেভাবে এ দু’শিক্ষক মেলামেশা করতো তাতে আমরা সহকর্মী হিসেবে তেমন কিছু মনে করতাম না। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। ওদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দু’সন্তানের জননী স্নিগ্ধা ভৌমিক ও এক সন্তানের জনক কামরুল ইসলামের পরকীয়া প্রেমের গল্প।

প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির পর সব শিক্ষকদের পরে  বের হতো স্নিগ্ধা ও কামরুল। প্রায়ই তারা মোটরসাইকেলে করে দূরে নিভৃত স্থানে গিয়ে সময় পার করতো। অ্যাড. রথীশ ভৌমিকের দুই সন্তানের মধ্যে এল.এল.বি অনার্স পড়ুয়া পুত্র ঢাকায় থাকতেন। নবম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা থাকতো বাসায়। কন্যা স্কুলে চলে যাওয়ার পর কামরুল পেছনের দরজা দিয়ে স্নিগ্ধার বাসায় গিয়ে গোপনে অবৈধ মেলামেশা করতো।

বিষয়টি রথীশ ভৌমিক আঁচ করতে পারলে তাদের সংসারে অশান্তি নেমে আসে।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৪ সালে গড়ে ওঠা তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৯৪ সালে অ্যাড. রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক ধর্মীয় শিক্ষক এবং কামিল পাস করা কামরুল ইসলাম একই সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। স্নিগ্ধা ভৌমিক শান্ত স্বভাবের হলেও কামরুল ইসলাম চতুর ও চঞ্চল প্রকৃতির। হাসি, ঠাট্টা করতো সবার সঙ্গে। দীর্ঘদিন চলার পথে শিক্ষক স্নিগ্ধা ও কামরুলের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে।

এ সম্পর্কের কারণে স্নিগ্ধার দাপ্তরিক যাবতীয় কাজকর্ম কামরুল করে দিতো। বিনিময়ে স্নিগ্ধা বাড়ি থেকে টিফিন বক্সে করে কামরুলের জন্য খিচুড়ি, ছানা, পায়েসসহ ফলমূল নিয়ে এসে তাকে খাওয়াতো। তার সহকর্মীরা প্রশ্ন করলেও স্নিগ্ধা বলতো আমার কাজ করে দেয় বিধায় তাকে নাস্তা খাওয়াই। এসব বিষয় জানতে পারেন স্নিগ্ধার স্বামী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি শিক্ষক কামরুলকে সাবধান করে দেন। এ থেকে তাদের  মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়।

সেই থেকে মোবাইল ফোনে কামরুল আর স্নিগ্ধা পরিকল্পনা করে কীভাবে আগের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা যায়। তারা দিনে কখনো ৩০-৩৫ বারও কথা বলেছেন। এসব বিষয় নিয়ে রথীশের পরিবারে নেমে আসে চরম অশান্তি। দেখা দেয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ও বিরোধ। স্নিগ্ধা প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বামীকে গালমন্দও করতো।

সম্প্রতি তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুলের বেপরোয়া চলাফেরা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রথীশ প্রধান শিক্ষিকাকে শোকজ করার তাগিদ দেন। এরই প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষিকা ৪ঠা মার্চ তাকে শোকজ করে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে উত্তর দিতে বলেন। শোকজ নোটিশ পাওয়ার পর কামরুল তার চিঠির জবাব দিলেও সন্তোষজনক না হওয়ায় ম্যানেজিং কমিটির নির্দেশে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় অভিভাবক সদস্য বিপুল সরকারকে। অপর দুই সদস্য হলেন- শিক্ষক প্রতিনিধি মতিউর রহমান ও সহকারী প্রধান শিক্ষক বেলাল হোসেন।

২৮শে মার্চ ওই তদন্ত কমিটি কামরুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরই মধ্যে ঘটে যায় ২৯শে মার্চ রাতে রথীশের হত্যার ঘটনা। শিক্ষক শাহরুল হুদাসহ অন্যরা বলেন, ৩০শে মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অ্যাড. রথীশ চন্দ্র ভৌমিক নিখোঁজ সংবাদ শুনে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ৩১শে মার্চ সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করি। ওই কর্মসূচিতে কামরুলও উপস্থিত ছিল এবং সে স্বাভাবিকভাবে কর্মসূচি পালন করে। তার চোখ- মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে, সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

এদিকে নিহত রথীশের হত্যাকাণ্ড ঘটনার রহস্য গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদপত্রে প্রকাশের পর রংপুরে জাতীয় ও স্থানীয় সব পত্রিকা দিনের অর্ধবেলায় বিক্রি হয়ে যায়। সর্বত্রই স্নিগ্ধা ও কামরুলকে নিয়ে চলে সমালোচনা।

রংপুর নগরীর বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ৩০শে মার্চ নিখোঁজ হন আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। তিনি জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও এবং মাজারের খাদেম হত্যা মামলার সরকারি আইনজীবী ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এ ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিদের দায়ী করে আওয়ামী লীগ, আইনজীবী সমিতি, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, ক্ষত্রিয় সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনে নামে। সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, সংবাদ সম্মেলন, গণঅনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের আন্দোলনে তোলপাড় শুরু হয় প্রশাসনে।

নিখোঁজ রথীশের সন্ধানে মাঠে নামে র‌্যাব, পুলিশ, পিবিআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরে আইনজীবীর স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক এবং তার সহকর্মী স্কুলশিক্ষক কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ষষ্ঠ দিন ৪ঠা এপ্রিল হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করা হয়।

স্নিগ্ধা ভৌমিক র‌্যাবকে জানায়, পরিবারিক কলহ, সন্দেহ ও অশান্তির কারণে সে পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হয়ে স্বামী রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে ভাতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তাকে এ কাজে সহায়তা করে তার কথিত প্রেমিক কামরুল।

তদন্তরত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, কামরুল শুধু দীপা ভৌমিকের পরকীয়া প্রেমিকই নয়, ওই সম্পর্কের সূত্র ধরে দীপা ভৌমিকের কাছ থেকে লাল লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তদন্তসূত্রগুলোর ধারণা রাধাবল্লভে কামরুলের যে দ্বিতল বাড়ি আছে তার আর্থিক যোগানও দিয়েছেন ওই দীপা ভৌমিক। কামরুল যে মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করতেন সেটিও দীপা ভৌমিকের দেয়া উপহার কিনা তাও খতিয়ে দেখছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
কামরুল ও দীপা ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে যুক্ত তদন্তরত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত কামরুল ইসলাম ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই স্কুলের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই সময়ের সভাপতির আনুকুল্যে একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়েও নিয়ম বহির্ভূতভাবে কামরুল ইসলাম বিভিন্ন পদ পদবি পান এবং নিয়োগসহ আর্থিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তোলেন স্কুলটিতে। এসময়কার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তার হাতের পুতুল।
কামরুল ও দীপা ভৌমিককে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে যুক্ত তদন্তরত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, সেই সময়ের স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি মারা যাওয়ার পর স্কুলটিতে সভাপতি হিসেবে আসেন অ্যাডভোকেট বাবু সোনা। এরপর তিনি শিক্ষক কামরুল ইসলামের সকল অবৈধ হস্তক্ষেপ কঠোরহস্তে দমন করেন এবং সিনিয়র শিক্ষকদের যথাযথভাবে দায়িত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মাধ্যমে স্কুলে একাডেমিক বিল্ডিং হওয়ার পাশাপাশি বহু উন্নয়ন হয়েছে। স্কুলের জমি নিয়ে সমস্যার ছিলও তার সমাধান হয়েছে কোর্টের রায়ের মাধ্যমে গত ১৪ মার্চ। কিন্তু কামরুল অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র এবং শৃংখলা বিরোধী কাজ শুরু করেন। আর তাকে রশদ ও সাহস জোগান প্রেমিকা ও সহকর্মী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক।
তদন্তরত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, কামরুলের সাথে দীপার অবাধ প্রেম ও অসামাজিক কার্যকলাপ এবং স্কুলে কামরুলের অবৈধ হস্তক্ষেপে দীপার সমর্থন ও কামরুলকে কারণদশাও নোটিশ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ উঠে যায় তুঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতার জন্য ৩০ মার্চ রাতে পারিবারিক সালিশের  দিনধার্য করা হয় হয়। কিন্তু পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কামরুলের স্কুলের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হওয়ার পরের দিন এবং দীপার সাথে পারিবারিক সালিশে আগেই দিন ২৯ মার্চেই নিজ বাড়ির নিজ শয়ন কক্ষেই দীপা ভৌমিক ও কামরুল ইসলাম বাবু সোনাকে হত্যা করে।
তদন্ত সূত্রগুলোর তথ্য মতে, ২৯ তারিখ রাতে বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর ওড়না পেচিয়ে বাবু সোনাকে হত্যা করে দীপা ভৌমিক ও কামরুল। লাশের গলায় ওড়না দিয়ে পেচানো সেই দাগ রয়েছে। এসময় তার পরনে শার্ট-প্যান্ট ও পায়ে জুতা ছিল। লাশ পেচানো ছিল বিছানার চাদর ও লুঙ্গি দিয়ে। সুরুত হাল রিপোর্টেও সে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
Print Friendly

Related Posts