টেকসই উন্নয়নে নিরক্ষরতা মুক্তির শিক্ষা কার্ড

এএইচএম নোমান

মুক্তিযুদ্ধের বিরাট সাফল্য ও বিজয়ের পর পরই দেশকে নিররমুক্ত করার লক্ষে এক দল মুক্তিযোদ্ধা নিররমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। দিনটি ছিল ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্থানটি ছিল আলেকজান্ডার প্রাইমারী স্কুল, রামগতি, বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা। বিপ্তি ও বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক যুবক, দেশপ্রেমিক, স্বচ্ছল-ব্যক্তি গোষ্ঠী এ ডাকে যোগ দেয় ও এগিয়ে আসে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সর্বপ্রথম উপকূলীয় রামগতি থানায় ২২ ফেব্রুয়ারি স্বেচ্ছাশ্রমে দেশ গড়ার ডাক দেন, ঐ স্থানটি এখন ‘শেখের কিল্লা’ নামে খ্যাত। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে ১৯৭২ সালে গণশিার আন্দোলনের ক-খ-গ, ১-২-৩ লিখা বুকে লাগিয়ে আমিসহ রামগতির শত শত মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ী-যুবক এর শুরু ও প্রদর্শন করি। বঙ্গবন্ধুর আগমন, স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা বাঁধা, দেশের প্রথম গুচ্ছগ্রাম, নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন, সয়াবীন, বাদাম, আলু তথা উৎপাদন রাজনীতির উৎসাহ প্রদানের এক কালের সাক্ষী ‘শেখের কিল্লা’ ঘিরে এখন শিক্ষা-গ্রাম পর্যটন কেন্দ্রসহ প্রস্ফুটিত জনপদ। নবগঠিত বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন’র মাধ্যমে বেতার সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এর নেতৃত্ব ও সমম্বয়ে সারা দেশে নিরক্ষরতা মুক্তির আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হয়।

এভাবে বৃহত্তর দিনাজপুরের বিরল থানার কচুবাড়ি কৃষ্টপুর দেশের প্রথম নিররমুক্ত গ্রাম সৃষ্টি ও ঘোষিত হয়। কুমিল্লা একাডেমীর গণশিক্ষা বিশেষজ্ঞ আবদুল কুদ্দুস, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফেরদৌস খাঁন এর বড়দের বইসহ প্রথমে বাজারে প্রচলিত আদর্শ লিপি ও পরে এঁদের বিশেষ বই ও নির্দেশিকা ‘চেতনা’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ছাপিয়ে সরবরাহ করা হয়। একইভাবে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনাব ফজলে হাসান আবেদ সুনামগঞ্জের দিরাই’র শাল্লা এলাকায় বিদেশী আর্থিক সাহায্যে, আরো মানসম্মত গণশিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিলেন যা এখন সারাদেশে মহিরুহ রুপে কাজ করছে। পাশাপাশি ৮০’র দশকে ও পরবর্তীতে সরকারের সচিব সিএসপি ড. এম এ সাত্তার তাঁর সহধর্মিণী মিসেস এলেন বাংলাদেশ গণশিক্ষা সমিতি BACE-স্থাপনের মাধ্যমে চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে মেহেরপঞ্চ গ্রামে উপানুষ্ঠানিক শিা কার্যক্রম চালু করেন। যতটুকু মনে হয় এটাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের প্রথম উদ্যোগ। এটাও বিদেশী আর্থিক সহায়তায়।

অপরদিকে স্বনির্ভর পদ্ধতিতে স্থানীয় উদ্যোগ-সম্পদে শার্শা ঝিকরগাছায় মাটি-কাঠি ও মুক্তাঙ্গন পদ্ধতি, রাঙ্গুনিয়ায়, সাদুল্ল্যাপুরের নলডাঙ্গায়, কিশোরগঞ্জে স্থানীয় সরকার-ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে, কাঁঠালিয়া, বেতাগী, মাগুরার শ্রীপুর, রামগতি এমন কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে গণশিক্ষা আন্দোলন ছড়িয়ে যায়। এ কার্যক্রমে রাজনৈতিক, সামাজিক, তথা রাষ্ট্রের গণমুখী ও গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত না থাকায় তা প্রথমে মুখ থুবড়ে পড়ে ও পরবর্তীতে থেমেই যায়। এর ফলে স্বদেশী, স্ব-সম্পদে দেশপ্রেমিকতার উপলব্ধিতা ও মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্যতা ও সমতার ডাক তথা শিক্ষার সাংবিধানিক অধিকার দিন দিন বৈষম্যতার শিকার হতে থাকে।

এখন দেশকে গড়ায় এগিয়ে নেয়ার পালা। ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের স্বার্থকতা আনতে সকলের গণসাক্ষরতা অভিযানসহ মানসম্মত শিক্ষা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথম কাজ হলো, আশু ব্যবস্থা হিসাবে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা চলমান রাখা। দ্বিতীয় কাজ হলো দীর্ঘ মেয়াদী অর্থাৎ এক প্রজন্ম ২০ বছর মেয়াদী একটি কার্যক্রম হাতে নেয়া।

দেশে ভাতাপ্রাপ্ত দরিদ্র মা’দের শিশুকে কেন্দ্র করেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিররমুক্ত পরিকল্পিত জনসম্পদের বাংলাদেশ রচনা করতে হবে। এই শিশুকে কেন্দ্র করে ‘শিা, সংস্কৃতি ও বিনোদন কার্ড’ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান শুরু হয়েছে তা চলমান রাখতে হবে যা শিশুর ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন সুরক্ষিত করবে। মাতৃত্বকালীন ভাতাকেন্দ্রিক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রমে শিক্ষা কার্ড অন্যতম একটি অংশ। ১. স্বাস্থ্য ২. শিক্ষা ৩. একটি ঘর ৪. জীবিকায়ন তহবিল/ সরঞ্জাম সম্বলিত স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে গরীবির কারণে নিরক্ষরতা অন্তরায় দূর হবে। ঊর্ধ্বে ২ শিশুর জন্য এ শিক্ষা কাডের্র আওতায় অন্তত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত জীবনভিত্তিক আনুষ্ঠানিক/ব্যবহারিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। এরপর যার যার স্বাধীন সিদ্ধান্তে শিক্ষা-দীক্ষা সমাপ্তে চাকরি বা শ্রমবাজারে যাবে। এ শিক্ষা কার্ড সরকারী মূল স্রোতধারায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার কাঠামোর সাথে যুক্ত হবে।

প্রথম পর্যায়ে বেসরকারি সংস্থা ‘ডরপ’ এবং পরবর্তীতে সরকারি ভাবে সারা দেশে এই ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ সমন্বিত উন্নয়ন মডেলটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দেশের সাতটি বিভাগের ১০টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করে। এই কার্ডে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর প্রদান করা হয়। কার্ড পেয়ে প্রতিটি মা-বাবা শিক্ষার উপর সরকার প্রদত্ত মালিকানা খুঁজে পেয়েছে। এতে স্কুলে যায়না, গেলেও ঝরে পড়ে, ইত্যাদি কথা আর থাকবে না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশী পয়সায় প্রকল্প পরিচালনা করা প্রয়োজন হবেনা। পরনির্ভরশীল হওয়া লাগবেনা।

ইতোমধ্যেই বঞ্চিত শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কাজ শুরু করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত উন্নয়ন তলরেখা মা’কে কেন্দ্র করে মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক শিশুদের এই আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুারোর আওতায় কার্যকরভাবে না আনা হবে ততদিন পর্যন্ত নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো যে, ২০১৭-১৮ থেকে সরকার মাতৃত্বকালীন ভাতা ২ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩ বছর মেয়াদ পর্যন্ত প্রদান করছে। এই ভাতা কার্যক্রম ৩ বছর থেকে ৫ বছর মেয়াদ পর্যন্ত করার আবেদন জানাচ্ছি, যাতে একই সঙ্গে এই শিশুরা ৫ বছর বয়স থেকেই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো আওতায় তালিকাভুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে আনুষ্ঠানিক পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। তাহলেই গুণগতমানসহ শিক্ষা ও মাতৃত্বে উন্নয়ন তলরেখা ধরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৪ (চার) তথা এসডিজি একের ভেতর সতের বাস্তবায়ন সম্ভব।
এএইচএম নোমান : প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডরপ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী-২০১৩।
ই-মেইল-nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts