২১ আগস্ট হামলার রায় ১০ অক্টোবর

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ বর্বরোচিত ও নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আনা পৃথক মামলার রায় ও আদেশের জন্য আগামী ১০ অক্টোবর তারিখ ধার্য করা হয়েছে।

রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে একুশে আগস্টের ওই ঘটনায় আনা পৃথক মামলায় একই সঙ্গে বিচার অনুষ্টিত হয়। মঙ্গলবার আইনি পয়েন্টে আসামীপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করার মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করে আদেশ দেয় আদালত।

একই সঙ্গে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই মামলায় জামিনে থাকা সাবেক ৩ আইজিপিসহ ৮ জনের জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোরও নির্দেশ দেন।

মামলার রায় ও আদেশের পূর্ব পর্যন্ত জামিনে থাকা আট আসামীর জামিন বাতিল চেয়ে শুনানি করেন সৈয়দ রেজাউর রহমান। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে মোশররফ হোসেন কাজল বলেন, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা ৫ উপধারা অনুযায়ি ৮ আসামীর জামিন বাতিলের এখতিয়ার আদালতের। আট আসামীর পক্ষেও তাদের আইনজীবীরা জামিন বহাল রাখার বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন।

রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামীপক্ষের যুক্তিতর্ক পেশ ও শুনানি শেষ হলে আদালত বলেন, দীর্ঘদিন বিচার কার্যক্রম শেষে এখন শেষ পর্যায়ে এসেছে। রায় ও আদেশের জন্য ১০ অক্টোবর বুধবার দিন ধার্য করে আদেশ দেয় আদালত।

আদালত বলেন, এ মামলায় আসামীগন তাদের আইনজীবী, গণমাধ্যম, আইন-শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যগনসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। সুপ্রিমকোর্টের অনেক বিশিষ্ট আইনজীবী এ মামলা পরিচালনায় এ বিচারিক আদালতকে অলংকৃত করেছেন। তিনি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এ মামলায় সম্পূর্ন ঘটনাকে সামনে এনে আইনি ব্যাখ্যার আলোকে রায় ও আদেশ দেয়া হবে। এ সময় আদালত সকলের দোয়া কামনা করেন। বিচারিক কার্যক্রমে পদ্ধতিগত ত্রুটি যেন না থাকে উল্লেখ করে আদালত, জামিনে থাকা ৮ আসামীর জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।

রায় ও আদেশের তারিখ ধার্য হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসঁলি সৈয়দ রেজাউর রহমান সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহের উর্ধ্বে থেকে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমরা প্রমান করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শুন্য করার জন্য ২১ আগষ্ট হামলা ইতিহাসের সবচাইতে নৃশংস, জঘন্যতম ও বর্বরোচিত হামলা। নিরস্ত্র মানুষের ওপর আর্জেস গ্রেনেডের মতো সমরাস্ত্র ব্যবহার এ উপমহাদেশে আর নেই। তারা এ মামলার সাফল্যের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল।”

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড ও অর্থ সরবরাহের উৎস, ঘটনার চক্রান্ত, আলামত ধ্বংসের অপচেষ্টা, মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহে নিরিহ জজমিয়াকে সম্পৃক্ত করা, প্রশাসনিক সহযোগিতার সকল বিষয় সাক্ষ্য-প্রমান অন্যান্য ডকুমেন্টস আদালতে পেশ করেছে। সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা আইন অনুযায়ি আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড হবে।”

রাষ্ট্রপক্ষের অপর কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ মামলায় মূল রহস্য উদঘাটন হয়েছে। এতে ঘটনার পরিকল্পনাকারীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন। এখানে মামলা সব আসামীদের মোটিভই এক। তিনি আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড প্রত্যাশা করেন।

১১৯ কার্যদিবস শেষে মামলাটি এই পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়েছে ২৯ কার্যদিবস আর আসামিপক্ষ নিয়েছে ৯০ কার্যদিবস।

২১ আগষ্টের ঘটনায় পৃথক মামলায় মোট আসামীর সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে ৩ জন আসামীর অন্য মামলায় মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় তাদেরকে মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। ৩ আসামী হলেন- জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল। এখন ৪৯ আসামীর বিচার অনুষ্টিত হয়েছে। এর মধ্যে এখনো ১৮ জন পলাতক। আসামীদের মধ্যে ৪৫ জনের যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়।

প্রসিকিউশনের অন্যতম সদস্য এডভোকেট ফারহানা রেজা বলেন, মামলার অভিযোগপত্র আমলে নেয়ার পর পলাতক ১৮ আসামীর বিষয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে তাদের হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ সব ধরণের আইনি প্রক্রিয়া শেষে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। এরমধ্যে যাদের বিষয়ে আইনে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার মতো ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিল। এ আইনজীবীরা পলাতকদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন।

আসামীরা হলেন-মাওলানা তাজউদ্দিন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা সাবেক এমপি শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, ব্যবসায়ী মো.হানিফ, মহিবুল মুত্তাকীন, আনিসুল মুরসালিন, মুফতি শফিকুর রহামন, রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু, জাহাঙ্গির আলম বদর, মো. খলিল, মো.ইকবাল, মাওলানা লিটন ও মুফতি আবদুল হাই। ফারহানা রেজা বলেন, পলাতক ১৮ জনের মধ্যে চারজন আসামীর বিষয়ে “রাষ্ট্র নিযুক্ত” আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়নি। তারা হচ্ছেন-আসামী সাবেক সেনা কর্মকর্তা এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান খান ও খান সাঈদ হাসান।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২২৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেয়। আসামীপক্ষে সাক্ষিদের জেরা করেছে। গত বছরের ৩০ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দের জেরা শেষের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।

বিচারের মুখোমুখি থাকা ৪৯ আসামির মধ্যে এতাদিন জামিনে ছিলেন-বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডি’র সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম। তাদের জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

মামলার আসামী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, সেনা কর্মকর্তা রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীসহ ২৩ জন কারাগারে রয়েছেন। তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।

বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান।

তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

উল্লেখ্য, এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা (প্রয়াত) আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে এই মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই মামলার অভিযোগপত্রে জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যোগ হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশররফ হোসেন কাজল বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে দেশের ক্ষমতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল হাওয়া ভবন। এ হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে ছিলেন তারেক রহমান। তিনি যেভাবে চালাতেন, সেভাবে কাজ হত। তার আশ্বাস ও সহযোগিতায় ২১ আগষ্ট হামলায় প্রশাসনিক সহাযোগিতা নিশ্চিত করা হয়। এ মামলার সকল আসামীর মোটিভ ছিল এক ও অভিন্ন।

Print Friendly

Related Posts