প্রাথমিক শিক্ষার হালচাল-করণীয়

মোঃ জসীম উদ্দিন

শিক্ষাই সর্বোত্তম বিনিয়োগ। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত যে জাতি তত উন্নত। কথাগুলো ধ্রুব সত্য। শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষনের মূল নিয়ামক।

১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পূর্ব পকিস্তান রাষ্ট্রের আমাদের অংশে শিক্ষা, অর্থনীতি, উন্নয়নসহ আরো অনেক কিছুতেই আমরা বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত ছিলাম। আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াই শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধে। বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার স্থপতি, এদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমরা পাই লাল সবুজের পতাকা খচিত স্বাধীন বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন ভংগুর দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাইতো শিক্ষার শিকড়ে হাত দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ করেন যা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তীতে আমরা হাটিহাটি পা পা করে বর্তমান অগ্রগতির অবস্থানে রয়েছি।

বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে ২০১৩ সালে একই সাথে ২৬১৯৩ টি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫০৯৯টি।

শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের বেতন পদমর্যাদা বৃদ্ধি, বেতন বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু, মিড ডে মিল চালুকরণ, প্রশিক্ষণ, জনবল ঘাটতি পূরণসহ সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। শিক্ষকদের বাড়ির কাছাকাছি পদায়ন করা হচ্ছে যাতে তারা দায়িত্বে সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারে। শিক্ষকদের বিভিন্ন পুরস্কারের ব্যবস্থা, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বীকৃতি এবং তাদেরকে সরকারি খরচে বৈদেশিক ভ্রমনের সুযোগ দেওয়া, শিক্ষার্থী উপবৃত্তি এবং আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণ।

সরকারের ইত্যাদি অভাবনীয় উদ্যোগের পরেও কেন যে কাঙ্খিত সেই লক্ষে আমরা পারছিনা যেতে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে।

শিক্ষার ভিত রচনা হয় প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে। সেই শিক্ষা নড়বড়ে হলে শিক্ষার্থীরা হোচট খেয়ে পড়ে সামনে এগুতে পারেনা। সরকারি নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। একটি প্রাথমিক স্কুলের সার্বিক পরিবেশ, শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠদান, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, ফলাফল, শৃঙ্খলা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়গুলো নির্ভর করছে সেখানকার শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষা অফিসসহ স্থানীয় প্রশাসনের উপর। সকলে মিলে দায়িত্বশীল হলে গুণগত শিক্ষা ও কাঙ্খিত প্রাথমিক শিক্ষায় পৌঁছব এবং সরকারের স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হব। প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করা, শিক্ষা বিভাগের কার্যক্রম মনিটরিং করা, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও পরামর্শ প্রদান মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় সকলকে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো আমার দায়িত্ব।

প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি :

স্কুলের পরিবেশ সাজানো গুছানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নয় যা আমরা নিজেরাই করতে পারি। শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণে শ্রেণিকক্ষ সজ্জিত নয়, শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলার অভাব, পাঠদানে ক্লাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারষ্পরিক আদান প্রদান কম হয়, শ্রেণিশিক্ষক অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের না আসার ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকার অভাব।

আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামো দুর্বলতা রয়েছে, সঠিকভাবে দৈনিক সমাবেশ হচ্ছে না, কো-কারিকুলাম কার্যক্রম সঠিকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না, স্কাউট কার্যক্রম কোন কোন ক্ষেত্রে নেই বা সঠিকভাবে হচ্ছে না, ক্লাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের গুণগত মান গড়পরতা ভাল নয়, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ইত্যাদি শিক্ষায় জোর কম।

অন্যদিকে মিড ডে মিল কার্যকর করতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও মনিটরিং হচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খেলাধুলা করানো ও প্রতিযোগিতার নিজস্ব কোনো উদ্যোগ নেই, অধিকাংশ শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ের সময়সূচির ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীল নন, শিক্ষকগণ প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তা শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাব, অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে (বিশেষভাবে গ্রামের) যথেষ্ট সচেতন নন, ম্যানেজিং কমিটি কাঙ্খিত মাত্রায় স্কুল মনিটরিং করছেন না, জনবলের অভাব রয়েছে, শিক্ষকগণ উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও আকর্ষণীয়ভাবে পাঠদানের উদ্যোগ চোখে পড়েনি, শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি যার যার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দায়িত্বশীল না, দায়িত্বে অবহেলা ও শৃঙ্খলাজনিত কারনে শিক্ষকদের বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নজির কম।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ পেশাগত সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন, শিক্ষা অফিসের জনবল সংকট, তাছাড়া পর্যাপ্ত মনিটরিং এর অভাব, অনেক দুর্গম এলাকায় বিদ্যালয় থাকায় তদারকিতে কেউ আসবে না তাই শিক্ষক ফাঁকি দেওয়ার প্রবনতা থাকে, অধিকাংশ দুর্গম বিদ্যালয়ে বছরের পর বছর শিক্ষক স্বল্পতা থাকে নিয়োগও দেওয়া হয়না, প্রধান শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রেই টিম লিডারের ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হন না, বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে শিক্ষা অফিসে কাজের অজুহাতে এসে শিক্ষকদের ঘুরাফেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির কাছে স্কুল হওয়ায় সকলেই স্থানীয় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন, কেউ কাউকে মানতে চান না।

উত্তরণের প্রস্তাব:

প্রাথমিক শিক্ষায় স্কুলের নিজস্ব ছোট খাট কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তা বাস্তবায়নে মনিটরিং জোরদার করতে হবে, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, জনবল সংকট কমিয়ে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন, প্রতিটি স্কুলে প্রশিক্ষক, স্কাউট, শিক্ষকের ব্যবস্থাকরণ, মনিটরিং জোরদারকরণের যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ (ডিজিটাল পরিকল্পনা), দায়িত্বে অবহেলা ও শৃঙ্খলাজনিত কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দায়িত্ব এবং উদ্ভাবনী ধারণার আলোকে ইউনিয়ন এবং কাস্টার পর্যায়ে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, বর্তমানে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে তাড়াই নিজ উপজেলা পদায়ন এর বিকল্প কার্যকরী পদায়ন নীতিমালা বিষয়ে ভাবা যেতে পারে , সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যের বইয়ের পাশাপাশি স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা যেতে পারে, স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে বিশেষ থোক বরাদ্দ প্রদান করা প্রয়োজন, শিক্ষক, অভিভাবক, এসএমসি সদস্যদের আরও দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে মোটিভেশনাল কার্যক্রম করতে হবে, শিখন, শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে কার্যকর পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

শ্রেণিকক্ষ, বিষয়ভিত্তিক পাঠদানে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, নিয়মিত ফলপ্রসু অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ আয়োজন করার জন্য এসকল কার্যক্রমে বরাদ্দ প্রদান, পাঠদানের সাথে সাথে ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করণে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা গ্রহণ এবং অভিভাব দের শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্বউদ্যোগে নিজ নিজ স্কুলে করণীয় ঠিক করতে হবে, নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, দেশপ্রেম, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে, প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ করে শিক্ষকসহ সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হতে হবে।

উপর্যুক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিয়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে, বর্তমান সরকারে মিশন এবং ভিশন বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।

 

মোঃ জসীম উদ্দিন  উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাহুবল, হবিগঞ্জ।

Print Friendly

Related Posts