ভুবনে দুহিতার আগমন ॥ গল্প

আব্দুল্লাহ আল মামুন

রাতের আকাশের তাঁরা গুনতে আর চাঁদ নিয়ে ভাবনা করতে গিয়ে ঘুমোতে একটু দেরি হয় সাংবাদিক সাহেবের। সেজন্য সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেলা গড়িয়ে যায়। প্রতিদিনই এমনই হচ্ছে সাংবাদিক সাহেবের। এ যেন একটা রুটিন হয়ে গেছে। নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরত। কিন্তু রাত জাগাটা ঠেকানো যাচ্ছে না। আজও বেলা ১১টায় তার মায়ের কথাগুলো কানে বেজে উঠলো। বলছিলেন, রুমানার ডেলিভারির তারিখটা পার হয়ে গিয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে সিজার করাতে হবে। এমনিতেই দুর্বল শরীর, তার ওপর খাওয়া-দাওয়াও কম করে সে। কি হবে? সেটাই চিন্তার বিষয়।

সাংবাদিক সাহেব এবার বিছানা ছাড়লেন। চিন্তিতভাবে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। কয়েক মিনিট পর ফিরলেন নিজের কামরায়। বিছানায় বসে ভাবছেন তিনি। একটা মাত্র বোন। যদি কিছু হয়ে যায়। অজানা ভয় মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এবার তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মনে মনে শক্তি সাহস দিলেন নিজেকে, ধ্যাৎ, ভেবে আর কি হবে? আল্লাহ ভাগ্যে যেটা নির্ধারন করে রেখেছেন, ঠিক সেটাই হবে।

আজ দ্রুত সকালে নাস্তা সারলেন। চায়ের জন্য চলে গেলেন বাসা থেকে একটু দূরে সড়কের পাশে চায়ের দোকানে। দোকানদার সাংবাদিক সাহেবকে দেখেই চা বানাতে শুরু করলেন। চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লেন তিনি। কানে বেজে উঠেছে চায়ের কাপে চামুচ দিয়ে নাড়ানো শব্দ। বেশ ভালোই লাগছিল যেন সাংবাদিক সাহেবের। হাতে চলে এলো ধোঁয়া ওঠা গরম চা। পরম আদরে চুমুক দিতে থাকলেন।

চা পানশেষে ফিরে এলেন বাসায়। আবারো সেই ভাবনা ঘিরে ফেলল তাকে। ছোট বোন রুমানার কথা ভাবতে লাগলো। ছোট বোনকে নিয়ে না ভেবে যে তার কোন উপায় নেই। বড় আদুরে যে। ছোট বোনটাকে তিনি তাঁর আত্মার চেয়েও বেশি ভালবাসেন। তার কিছু হলে সে সহ্য করতে পারে না। নিজের মনের ভেতর কষ্টগুলো জিইয়ে রাখে সে। কাউকে বুঝতেও দেয় না সে। ভাবনাগুলো তাড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরে টিভি দেখার ঢুকলেন। এভাবে দুপুর গড়িয়ে এলো। এবার গোসলের প্রস্তুতি। গোসল শেষ করে খাবার খেয়ে রওনা দিলেন অফিসের দিকে।

সড়কে এসে সিএনজি চালিত অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা। তেমন কোন ঝামেলা নিতে হয় না তার। প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সিএনজি অটোরিকশা তার অফিস যাওয়া-আসার সময় অপেক্ষা করে। স্ট্যান্ডে এসেই সিএনজি অটোরিকশায় বসে পড়লো। চলতে শুরু করলো সিএনজি। ফের ছোট বোন রুমানাকে নিয়ে ভাবনা ঘিরে ধরলো। সিজার করতে গিয়ে অনেকের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। রুমানার যদি কিছু হয়ে যায়। রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। সাংবাদিক সাহেব আর তার ছোট বোনের রক্তের গ্রুপ একই হলেও আপাতত ডোনেট করতে পারছে না।

একসময় গন্তব্যে এসে থেমে গেল সিএনজি। অফিসের কাছে রাস্তার পাশে এক দোকান থেকে চা পান করলেন সাংবাদিক সাহেব। চা শেষ করে ধেই ধেই করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে চললেন অফিসের তলায়। অফিসে প্রবেশ করে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। এরপর শুরু করেন নিজের কাজ। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মফস্বল সংবাদের দায়িত্বে তিনি নিয়োজিত। অফিস চলাকালীন সময়টুকু খুব ব্যস্ততায় কাটে সাংবাদিক সাহেবের। একটা ফোন রিসিভ করার মত সময় থাকে না তার। কাজ শেষ করে সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে পড়েন।

এবার ঘরে ফেরার যাত্রা। একটা সিএনজি অটোরিকশায় উঠলেন। চলতে শুরু করলো সিএনজি। সড়কের পাশে ঝিল, ফাঁকা রাস্তা। সাই সাই করে চলছে সিএনজি। সড়কের দু’ধারে মৃদু আলোর মুর্ছনা। বেশ উপভোগ করার মত। আলো আঁধারের মাঝে দুষ্টু শিশুদের মত সড়কের পাশে উঁকি দেয় ফুলগুলো। ঝিল পাড়ে রেস্তোরাগুলো বেশ জমজমাট। ঝিল পাড় যেন বিনোদনকেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে।

সিএনজি গন্তব্যে এলে নেমে পড়েন তিনি। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে ওঠে। পকেট থেকে বের করে দেখেন তার মায়ের ফোন। আবার সেই দুশ্চিন্তাটি ভর করলো তাকে। মা জানালেন, সবাই হাসপাতালে যাচ্ছি। আজ রাতেই সিজার হবে। সাংবাদিক সাহেবের চিন্তাটা আরো বাড়লো। তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে হাসপাতালে আসতে হবে কি না? মা জানান, এখন আর আসতে হবে না। তুমি বাসায় যাও। তার মায়ের কাছে তিনি জানতে চাইলেন, রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে কি না? জবাবে মা জানালেন, রক্তের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই আবারো মায়ের ফোন। জানালেন, এখনই হাসপাতালে আসতে হবে। সবাই এসে গেছে। মুখে সামান্য কিছু দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাসা থেকে হাসপাতাল বেশি একটা দূর নয়। হেঁটে চললেন হাসপাতালের দিকে। মনের ভেতর টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে সাংবাদিক সাহেবের। হাঁটার পথে ফোনে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিলেন। হাসপাতালে ঢুকেই সিঁড়ি বেয়ে চললেন অপারেশন থিয়েটারের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলেন অন্য সব আত্মীয়-স্বজনরা আগেই এনে গেছে। তারা অপেক্ষা করছে। সাংবাদিক সাহেবের চাচাতো ভাই ও তার স্ত্রী হাসপাতালে এসেছে। তারা সাংবাদিক সাহেবকে সান্তনা দিচ্ছেন। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। অপারেশন থিয়েটারের সামনে সাংবাদিক সাহেব একাই বসে রইলেন। তার বোন বলে কথা।

খানিক বাদে অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে সবাই জড়ো হলেন। খুললো অপারেশন থিয়েটারের কপাট। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। কিন্তু না। খবর আসলো অন্য এক রোগির। টিউমার অপারেশন হয়েছে। হুঁড়মুঁড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লো রোগির স্বজনরা। সামান্য টিউমার অপারেশনের জন্য রোগির স্বজন এসেছে ১১ জন। আধ ঘন্টা পর তারা হাসপাতালের নিচে গেলেন।

অপারেশন থিয়েটারের সামনের অংশ আবারো ফাঁকা হয়ে গেল। সাংবাদিক সাহেব একাই বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর তার চাচাতো ভাইয়ের বউ আসলেন। কুশল বিনিময়শেষে তাকে সান্তনা দিলেন। এরপর প্রস্থান। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতেই চায় না সাংবাদিক সাহেবের। ইতিমধ্যে অপারেশন যে শুরু হয়েছে, তা কেউ বুঝতে পারেনি। সাদা এপ্রোন পরিহিত এক মহিলা অপারেশন থিয়েটার থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেলেন। কোন সমস্যা হলো না তো? তাকে জিজ্ঞাসা করলেন সাংবাদিক সাহেব। জবাবে নার্স জানায়, সেলাই করার সুঁতো ছিল না। তাই সুঁতো নিতে বের হয়েছিলেন। বলেই ভেতরে চলে গেলেন।

খানিক বাদে সাদা সেই নার্স এসে জানতে চাইলেন যে, নবজাতকের বাবা কে? সাংবাদিক সাহেব বললেন, কিন্তু কেন? নার্স বললেন, প্রয়োজন আছে। বলেই সে চলে গেলেন। মিনিটখানিক বাদে তিনি আবারো আসলেন। সাথে আরো ৩ জন। ফের সেই একই প্রশ্ন। কিন্তু কেন খুঁজছেন তাকে? নার্স জানালেন, বখশিস ছাড়া কিন্তু ছাড়ছি না। এরই মধ্যে সাংবাদিক সাহেবের ভগ্নিপতি এসে হাজির। নার্সের হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বললেন, আমার বাচ্চার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। নার্স বললেন, স্যার এটা তো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আপনি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।

মিনিট দশেক বাদে এক নারী চিকিৎসক এসে জানালেন মা ও শিশু দুজনই ভালো আছে। তার কন্যা সন্তান হয়েছে। নার্সরা নবজাতক শিশুকে তার স্বজনদের হাতে তুলে দিলেন। জানালেন, মায়ের শারীরিক অবস্থা যদি ভালো হয়, তাহলে রাতের মধ্যেই বেডে দেওয়া হবে। নয়তো সারারাত আইসিওতে রাখা হবে।

নানুর কোলে চলে সদ্যভূমিষ্ট নবজাতক উপরের তলায় চলে গেল। পরম আদরে তার বড় ভাই আন্নাফির কোলে চলে আসলো। সবাই নবজাতক শিশুটির ছবি তোলায় ব্যস্ত। শিশুটি অন্য বাচ্চাদের মতো নয়। একটু আলাদা। ছবি তোলার সময় চোখ বন্ধ করে নয়, চোখ মেলে আছে। মনে হয় যেন, ছবি খারাপ না হয়, সেজন্য চোখ মেলে পরম আদরে ছবি তুলছে দুহিতা।

চিলেকোঠার শহরে শশীর আলো হয়ে যেন ভুবন রাঙাতে দুহিতার আগমন। পরম আদরে সবাই জানাচ্ছে স্বাগতম।

তার মামা সাংবাদিক সাহেব বলে উঠলেন, তব আধারের বুকে এক ছটা রোদ্দুর। নিয়নের আলোর ডানায় হাওয়া মেলুক খোলা আকাশে।

Print Friendly

Related Posts