এ বছরের বিজয় দিবস সময়-বিচারে অনন্য

খান চমন-ই-এলাহি

ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এলো এবার আমাদের বিজয় দিবস-ষোল ডিসেম্বর। দিনটি অন্যান্য বছর থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদার দাবি রাখে। এ বছরের নির্বাচন স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা। যে নির্বাচনে বাঙালি ও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা। আর এ বছরের নির্বাচনে অর্জিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর বাংলাদেশে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। এ বছরের ষোল ডিসেম্বর তাই ত্রিশ তারিখের সাধারণ নির্বচনে ভূমিকা রাখছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নাড়া দেয়। দোলা দেয়। আবার অনেকের মনে শঙ্কা ভয় জাগ্রত হয়।

আসলে নির্বাচন হবে কি? অথচ অনেকে বুঝতে চায় না, নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার। বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসে, লাল সবুজের পতাকা যারা উড্ডীন দেখতে চায়, জাতীয় সঙ্গীত যারা কণ্ঠে ধারণ করতে চায় এবং যারা পদ্মা মেঘনা যমুনা মধুমতি কর্ণফুলি হরিণঘাটার স্রোতে বিশ্বাস করে তারা স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছে। নিশ্চয়ই, ভালো ফল পাওয়া যাবে। এমন আশা-প্রত্যাশা থাকাই স্বাভাবিক এবং নাগরিক অধিকার। আইনের চোখে সবাই সমান। তাই ভোটাধিকার প্রয়োগে ভয়-ভীতি পেতে হবে না। ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ নির্মাণে সহায়ক হবে।

বিজয় দিবসের কথা এলেই আমাদের ফিরে যেতে হয় ১৯৭১-এ। আমাদের ফিরতে হয় আরো, আরো পেছনে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজের পরাজয়ে না ফিরি, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের কূচক্রান্তে না ফিরি, বাঙালির স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার ইতিহাসে না ফিরি, বৃটিশ উপনিবেশে-কলোনিতে না ফিরি, বৃটিশ-ভারতে না ফিরি; আরো পেছনে না ফিরি সময় ও কলেবর বৃদ্ধির হেতু। বাঙালি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তো ফিরতে হবে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে তো ফিরতে হবে। ভুললে তো হবে না। আমরা যতই আমাদের ভাবনা ও ইতিহাস সংক্ষেপ করতে চাই না কেন, এতটুকু বিনিময় তো থাকতেই হবে, যা আক্ষরিক অর্থে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বাঙালি ফিরতে চাইলে ফিরতে পারে পাল-সেন যুগ অতিক্রম করে হাজার হাজার বছর পেছনে। সেভাবে এ মূহুর্তে ফিরছে না। ফিরছি না কেউই।

তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা, চট্রগ্রামের বেতার কেন্দ্র, মুজিবনগর সরকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ও বিজয়ে তো ফিরতে হবে। না হলে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পাবো কীভাবে? বিজয়ের কথকতা কী? ইতিহাস কী?

ধীরে ধীরে হলেও আমাদের যেতে হবে দ্বিজাতি তত্ত্বের কাছে-লাহোর প্রস্তাবে। কবি আল্লামা ইকবালের কাছে। আমাদের যেতে হবেই জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিংবা বাংলকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রবন্ধ প্রস্তাবে, যেতে হবে উনিশশত সাত চল্লিশের চৌদ্দ আগস্টে। যেতে হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে, যেতে হবে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদ আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ‘উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে’ ঘোষণার কাছে।

আমরা কি না ফিরে যেতে পারবো ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে? যেদিন রফিক শফিক বরকত জব্বার সালাম বুকের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে পৃথিবীতে বাঙালিই প্রথম পারলো মাতৃভাষা বাংলার জন্য রাজপথে ত্যাগ করতে। বুকের রক্তে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যদা লাভ করলো। ফলে নির্মিত হলো শহীদ মিনার। যে মিনার এখন পৃথিবীর তাবৎ ভাষাভাষী মানুষের প্রাণের মিনার। মায়ের মমতায় সম্মানের সাথে যার নাম লেখা, আমি কী না ফিরতে পারি, আমার মায়ের কাছে? নিশ্চয়ই না। তাহলে আমাকে বলতেই হবে বায়ান্নর পথ ধরে এসেছে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়। যে বিজয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী পরিষদে কণিষ্ঠ মন্ত্রীও হয়েছিলেন। যদিও অসহযোগিতার জন্য যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি তবে বাঙালি জেনেছে কীভাবে ক্ষমতায় যেতে হবে? কেন ঐক্য দরকার?

এরপর পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র এলো, নিষ্ঠুর দুঃশাসন এলো আর এলো অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুমের যাতাকল। পিষে দিলো মানুষ, মানুষের অধিকার আর মানবতা। গণতন্ত্রের নামে বৈরী বাতাস এলো-মৌলিক গণতন্ত্রের ফানুস উড়ালো, লাটাই থাকলো ক্যান্টনমেন্ট ও মুখোশের ভেতর। রাষ্ট্রের বুকে সন্ধ্যা নামলো, পাকিস্তানের ডালে ডালে হুতুমপ্যাচা আর শকুনের উৎপাত দেখা দিলো। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন হলো। খুব দেরিতে নয়, দ্রুত চলে এলো ‘বাঙালির বাঁচার দাবি ছয় দফা’। আমি কি না ফিরে পারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কাছে। যে মামলার লক্ষ্য ছিলো ছয় দফা নস্যাৎ করার, যে মামলার প্রধান আসামী ছিলেন কিংবদন্তির প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি কি না ফিরে পারি তাঁকেসহ সকল রাজবন্দি মুক্তির আন্দোলনে। যেখানে মনু মিয়াসহ ১১ জন শহীদ হয়েছে বাঙালির প্রতি বাঙালির ভালোবাসায়। আমি কি না ফিরে পারি ৬৬-র সেই দেখানো পথে? ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ? না, আমাকে যেতে হয় আমাদের কাছে। ভয়াল দিনে। অতঃপর যেখানে নতুন দিনের প্রতীক্ষা! সুবেহ সাদিক! আযান কিংবা শঙ্খধ্বনি!

সরকার বাধ্য হলো নির্বাচন দিতে। দেশের উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার আর কোনো উপায় নেই। তাহলে কবে সেই নির্বাচন? সত্তরের ডিসেম্বরে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এ নির্বাচনে আর কেউ নয়-স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পায়। সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। তবে কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিব? নিয়ম অনুযায়ী, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে। অথচ হলো না। সব আশা নস্যাৎ হলো। উল্টো পথে হাঁটলো পাকিস্তান ও তার জোরজবরদস্তিমূলক সরকার। ফল ভালো হলো না। বাঙালি বেঁকে বসলো। মুজিব স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন আর জালিম শাসকদের সাথে থাকা নয়। অনেক হয়েছে! এখন বাঙালির স্বাধীনতা চাওয়া যায়। মধুমতি, বুড়িগঙ্গা আর তুরাগের পানি গড়িয়ে দূর, বহুদূর…। এভাবে বসে থাকা যায় না। একটা বিহিত করা চাই। আলোচনাও চললো। ফল ভালো হলো না। উল্টো ফল হলো। অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু হলো। ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে উড়লো পতাকা। ক্ষুব্ধাবস্থা চেপে রাখা যায় না। বিস্ফোরণ হবে। হলোও তাই। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা হলো, বাঙালির কবি দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে গাম্ভীর্য নিয়ে ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যুদ্ধ শুরুর পথে। ২৫ মার্চ তাই নারপিশাচ পাকিস্তান সরকার ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ নামে ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় নির্দোষ-পাপশূন্য গভীর ঘুমে থাকা মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।

শেখ মুজিব ভবিষ্যৎ বুঝতে পারলেন। তিনি ওই রাতের প্রথম প্রহরে বাঙালি ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ওয়ারলেস ম্যাসেজ দিলেন, সে ম্যাসেজ পঠিত হলো। জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম এ হান্নানরা নেতার আদেশ-নির্দেশ মতো সব কিছু করলেন। বাঙালির প্রাণপ্রিয় মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ছয় দফা, ৭ মার্চ ও ম্যাসেজের আলোকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন। ইতোমধ্যে মহান নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলে রাখা হয়েছে। অতঃপর জুলুমবাজ ফ্যাসিস্ট পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে কবর পর্যন্ত খোঁড়ে। তবু ভয় নেই, বীর বাঙালির ভয় নেই; ভয় নেই প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের। ফলে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকার শপথ বাক্য পাঠ করে। এগারো সেক্টরে যুদ্ধ চলে। নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। জয় লাভ করে বাংলাদেশ। পরাজিত হয় পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসররা। লক্ষ্য অর্জিত হয়। মুক্তি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রাপ্তির ফলে পতাকা ওড়ে, বিশ্বমানচিত্রে অংকিত হয় মানচিত্র, গাই জাতীয় সঙ্গীত।

আমরা বহু দূর এসেছি। আমাদের অর্জন অনেক। পৃথিবীতে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে। বিশ্বে আমাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু কালের যাত্রাপথে টিকে থাকতে হলে, স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে সম্মানের সাথে বাঁচতে হলে অর্থনৈতিক মুক্তি দরকার। যৌক্তিক, ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্ব প্রকার উন্নয়ণ দরকার। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দরকার। সংবিধানের আলোকে সুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দল-মত-পথ নয়, দেশ সকলের এ উপলব্ধি দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণ দরকার। যদি এমন স্বপ্ন, এমন ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হই, তবেই এবারের বিজয় দিবস সার্থক হবে। ত্রিশ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ভুল বুঝাবুঝি হবে না। রক্তপাত, হানাহানি হবে না। সুশৃঙ্খলা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, জনজীবনের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিকতাও বিঘিœত হবে না। নিশ্চয়ই, সংবিধানের ছায়াতলে থাকবে জাতি।

খান চমন-ই-এলাহি: অ্যাডভোকেট, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কবি

Print Friendly

Related Posts