যে শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আওয়ামী লীগের দু’বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও কিশোরগঞ্জ-১ আসনের এমপি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। রোববার রাজধানীর বনানী কবরস্থানে বাদ আসর তার দাফন সম্পন্ন হয়।

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সৈয়দ আশরাফের জানাযার পর হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানে দুপুর সোয়া ১টায় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনটায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাঁ মাঠে তৃতীয় জানাযা শেষে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদের মরদেহ ঢাকায় এনে আসরের পর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সৈয়দ আশরাফ ৩ জানুয়ারি ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। ৬৭ বছর বয়সী এ রাজনীতিবিদ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

সৈয়দ আশরাফের লাশ ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছায়। উড়োজাহাজ থেকে নামানোর পর লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই সাফায়েত উল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতারা। বিমানবন্দরেই এই মুক্তিযোদ্ধার কফিন ঢেকে দেওয়া হয় জাতীয় পতাকায়। সেখান থেকে আশরাফের লাশ নেয়া হয় বেইলি রোডে তার সরকারি বাসভবনে। রাতে আশরাফের লাশ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়।

Sayed-ashraf
মহৎপ্রাণ এই রাজনীতিকের শূন্যতা কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়

সকাল ১০টা ৩৪ মিনিটে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার প্রথম নামাজে জানাযায় ছিল লাখো মানুষের ঢল। জানাযায় অংশ নেন মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, ব্যবসায়ী ও সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সংসদ প্লাজায় এমপি বা সাবেক এমপিদের জানাযায় সাধারণ যত মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, সৈয়দ আশরাফের জানাযায় উপস্থিতি ছিল কয়েক গুণ বেশি। দক্ষিণ প্লাজার ওপরের চত্বর পূর্ণ হয়ে সিঁড়ি এবং সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাযায় অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। মানুষের এই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

সকাল সাড়ে ১০টার কিছু আগে সৈয়দ আশরাফের কফিন সংসদ চত্বরে আনার পর একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। পরে আশরাফের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী আশরাফের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।
জানাযার আগে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন আশরাফের ছোট ভাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

এ সময় ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনীতির মাঠে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিয়োগে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করা দুরূহ। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। আমাদের ছেড়ে তার চলে যাওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য এক বড় শূন্যতা।

এরপর হেলিকপ্টারে করে সৈয়দ আশরাফের লাশ কিশোরগঞ্জে নেয়া হয়। লাখ লাখ মানুষের মানুষের অংশগ্রহণে কিশোরগঞ্জে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১ টায় মরহুমের লাশ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে পৌছে এবং দুপুর সোয়া একটায় মরহুমের জানাযা নামাজ শুরু হয়। প্রিয় নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার টানে নামাজ শুরু হওয়ার অনেক আগেই দূর দূরান্ত থেকে আসা সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে পাঁচ একর আয়তনের বিশাল ঈদগাহ মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

সেখান থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে বিকেল ৩টার দিকে জানায়ায় জনতার ঢল নামে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ এই জানাজায় অংশ নেয়। জানাযাস্থল পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তখন এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ। স্মৃতিকাতর হয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সৈয়দ আশরাফের সঞ্চালনায় ছাত্রলীগের সভায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিলো। পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মহৎপ্রাণ এই রাজনীতিকের শূন্যতা কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফ। লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে প্রবাসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আশরাফ। এরপর ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে পুননির্বাচিত হন। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন হাসপাতালে থেকেই।

Print Friendly

Related Posts