বাংলাদেশের ডায়াবেটিস: প্রতি তিনজনে একজন অন্ধত্বের ঝুঁকির মধ্যে

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেফারেল নেটওয়ার্ক প্রকল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ)’র হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি ডায়াবেটিক রোগীর প্রতি তিনজনে একজন ডায়াবেটিক জনিত অন্ধত্বের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অসচেতনতার অভাবে ডায়াবেটিস আছে এমন লোকজনের মধ্যে অর্ধেকই জানেন না যে তাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে। ফলে প্রতিবছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়াবেটিক জনিত অন্ধত্ব এবং অনাকাংখিত মৃত্যু।

ডায়াবেটিক সমিতি এবং অরবিস ইন্টারন্যাশনালে যেীথ উদ্যেগে ঢাকার স্খানীয় একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেফারেল নেটওয়ার্ক তৈরি’ শীর্ষক প্রকল্প উদ্বোধন ও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বুধবার বক্তারা এ তথ্য জানান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্তিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের সচিব মো: আসাদুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্তিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরে মহাপরিচালক প্রফেসর ডা: আবুল কালাম আজাদ,ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ডা: একে আজাদ খান।

অরবিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিরেক্টর অব প্রোগ্রামস্ মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের সঞ্জালনায় এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা: মুনীর আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা: সাইফুদ্দিন আহমেদ, সিবিএইচসি’র লাইন প্রতিনিধি, এনসিডিসি’র লাইন ডিরেক্টর নূর মোহাম্মদ, স্বাস্থ্য অধিদফতরের এডিজি প্রফেসর এএইচএম এনায়েত হোসেন প্রমুখ।

আরো উপস্থিত ছিলেন আইএনজিও ফোরাম ইন আই হেলথ্ ও বাডাস-এর সহযোগীবৃন্দ এবং স্বনামধন্য চিকিৎসকগণ।

প্রকল্পের অংশ হিসেবে অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি – বাডাস গোপালগঞ্জ, বগুড়া, নেত্রকোণা ও শেরপুরে ডায়াবেটিস রোগ ও ডায়াবেটিস জনিত চোখের সমস্যা নির্ণয়ে ৪০০ কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জেলা পর্যায়ে ৪টি ডায়াবেটিস হাসপাতালে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরিসহ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে ৬০টি আউটরিচ ক্যাম্প করা হবে। পাশাপাশি ডায়াবেটিস জনিত চোখের রোগের প্রয়োজনীয চিকিৎসা ও ফালো-আপের জন্য গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বগুড়া স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতাল ও ময়মনসিংহের ডা. কে. জামান বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে রেফার করা হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য সচিব মো: আসাদুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সরকারী একটি জরিপে (স্টেপস ২০১৮) দেখা গেছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৭৬ লাখের বেশি মানুষই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ ছাড়া আরও কয়েক লাখ শিশু জম্মগতভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০.১ মিলিয়ন, যাদের ২.৫ মিলিয়ন ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত। পাশাপাশি, প্রতিবছর বাংলাদেশে ০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার নতুন করে ডায়াবেটিকে আক্রান্ত হচ্ছে। অসচেনতার কারণে ডায়াবেটিকে আক্রান্ত শিশুদের কেউ কেউ দৃষ্টিহীন আবার অনেকে ভুগছে চোখের মারাত্মক জটিলতায়। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও সুচিকিৎসার জন্য গোপালগঞ্জ, বগুড়া, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত ৪০০ কমিউনিটি ক্লিনিককে যুক্ত করে একটি শক্তিশালী রেফারেল নেটওয়ার্ক তৈরির যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তাকে আমি স্বাগত জানাই এবং সরকারী সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অর্ধেকই অবগত নন যে তাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে।

আরেকটি আশঙ্কার কথা হলো, পাঁচজন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে চারজনেরই বসবাস নিম্ন আয় ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। অসচেতনতা ও প্রচারের অভাবে এখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশিরভাগ ব্যক্তিরা চোখের চিকিৎসা করাচ্ছেন না। অথচ ৭০% ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্ধ হাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি ডায়াবেটিসজনিত চক্ষু স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়তে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করার পাশাপাশি এই রেফারেল নেটওয়ার্ক তৈরিতে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি – বাডাস এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি চোখের চিকিৎসায় এই কর্মসূচি গ্রহণের জন্য অরবিসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দেশব্যাপী ৫৪টি বাডাস হাসপাতালগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর চক্ষু পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে চক্ষু চিকিৎসা সেবাকে সম্বন্বয় করা জরুরি। যেন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা একই সাথে চোখের পরীক্ষা করাতে পারেন। এতে করে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি জনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

অরবিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মুনীর আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীই ডায়াবেটিকজনিত অন্ধত্বের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ রোগে রোগীর চোখে তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। ফলে নীরবে চোখের ক্ষতি বাড়তেই থাকে। তাই এ রোগের ব্যাপারে প্রতিরোধটা বেশি জরুরি। চোখের ভেতর রেটিনার রক্তপাত হওয়ার আগেই যদি প্রতিরোধ করতে পারা যায়, আক্রান্ত রক্তনালিগুলোর যদি সময়মতো চিকিৎসা করানো যায়, তাহলে অন্ধত্ব প্রতিরোধ সম্ভব।

প্রকল্পের আ্ওতায় প্রায় ১৭০০ স্বাস্থ্য কর্মীকে প্রশিক্ষণ, প্রায় ৩ লক্ষাধিক রোগীকে চিকিৎসা সহায়তা, প্রায় ২২,০০০ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগীর চোখের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং দরিদ্র পরিবারের ৩১৫ জনকে ‘ভাউচার স্কীমে’র মাধ্যমে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।

Print Friendly

Related Posts