স্বাস্থ্য অধিদপ্তর: কেরানি আবজাল ও স্ত্রী রুবিনার কত সম্পদ!

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বাম হাতে রোলেক্সের ঘড়ি, আঙ্গুলে হিরার আংটি। উত্তরার এক সড়কে পাঁচটি বাড়ি। গুলশান, বনানী, বারিধারায় ২০টি, সারাদেশে প্লট-বাড়ি কেনায় সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। শুধু দেশেই নয়; সম্পদের পাহাড় গড়েছেন মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রেও। দেশে-বিদেশে তার মোট সম্পদকে টাকায় হিসাব করতে হিমশিম খাচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। তবে ২৪ বছরের চাকরি জীবনে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো সম্পদ অর্জন তার।

তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আবজাল হোসেন। অধিদফতরের সিনিয়রদের যোগসাজশে কেনাকাটার টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। বদলি বাণিজ্যও করতেন। তবে দুর্নীতি আর অবৈধ আয়ে সিনিয়রদেরও টপকে গেছেন আবজাল। বাংলাদেশের সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হাজার, দুই হাজার, তিনহাজার কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ থাকলেও আবজাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে সেগুলোর সন্ধান পেতে শুরু করেছে দুদক।

সীমাহীন দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানি আবজাল হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার নামে-বেনামে থাকা বিশাল পরিমাণের সম্পদ। একই প্রতিষ্ঠানের স্টেনোগ্রাফার আবজালের স্ত্রী রুবিনা খানম আছেন স্বামীর এককাঠি ওপরে। তার সম্পদ আরও বেশি। নিম্ন পর্যায়ের দুই কর্মচারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেখে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা রীতিমতো বিস্মিত।

দুদক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ কেরানি ও স্টেনোগ্রাফারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ কমিশনে পেশ  করা হয়। অভিযোগটি যাচাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। দুদক উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষ টিম অনুসন্ধানে নামে। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী ও উপসহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান।

টিমের অনুসন্ধানে আবজাল ও রুবিনার নামে স্থাবর-অস্থাবর বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাওয়া গেছে। যা তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাদের নামে বাড়ি, গাড়ি, জমি, প্লট, মেয়াদি আমানত, বিভিন্ন ব্যাংকে জমানো টাকা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের সম্পদ পাওয়া গেছে। অর্থ পাচার করে বিদেশেও সম্পদ বানিয়েছেন তারা। অনুসন্ধানে তাদের নামে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

আবজাল-রুবিনার নামে দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করেছে দুদক। এর বাইরে আরও সম্পদ আছে, যা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনুসন্ধান টিমের প্রধান সামছুল আলম বলেন, আবজাল ও রুবিনার বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরও কিছু তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এদিকে অভিযোগ সম্পর্কে আবজালের বক্তব্য জানার জন্য তার মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হয়। তবে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

আবজাল হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (কেরানি) ছিলেন। দুদক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করায় এরই মধ্যে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। স্ত্রী রুবিনা একই অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

আবজালের যত সম্পদ : দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আবজাল নামে থাকা সম্পদের একটি তালিকা। তার নামে থাকা স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর উত্তরার ১৫/সি সেক্টরের ২/বি সড়কে ২৪ নম্বর প্লটে তিন কাঠা জমি, উত্তরার একই সেক্টরের একই রোডের ২৬ নম্বর প্লটে আরও তিন কাঠা জমি, রাজধানীর মিরপুরে পল্লবীর বাউনিয়া মৌজায় ৬ কাঠা জমি, একই মৌজায় আড়াই কাঠা জমির ওপর টিনশেড বাড়ি, খিলক্ষেতের ডোমনীতে ৩ কাঠা জমি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৪ কাঠা জমি, ফরিদপুর কোতোয়ালি পৌরসভার রঘুনন্দনপুর মৌজায় ১৩.৫ শতাংশ জমি, ফরিদপুর কোতোয়ালি পৌরসভার হাবেলী মৌজায় ১৫ শতাংশ জমির ওপর দুই তলা বাড়ি, খুলনা সিটি করপোরেশনের খালিশপুরে বয়রা মৌজায় ৩.৩৪ কাঠা ও ৫.৪৫ কাঠা জমি, ফরিদপুর জেলার টেপাখোলা ইউনিয়নে ১১৩.২৭ শতাংশ জমি, রাজবাড়ী জেলার বসন্তপুর মৌজায় ২২৯.২৫ শতাংশ জমি।

রুবিনার সম্পদ আরও বেশি : রুবিনার নামে থাকা স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে উত্তরার ১৩ সেক্টরে ১১ নম্বর রাস্তায় ৪৭ নম্বর প্লটে তিন কাঠা ১ শতক ২৭ বর্গফুট জমিতে ছয়তলা বাড়ি, একই সেক্টরের একই রোডে ১৬ নম্বর প্লটে তিন কাঠা জমিতে ছয়তলা বাড়ি, জোয়ার সাহারায় এনআর কমপ্লেক্স নামে ভবনে এক হাজার ১৪৬ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, মিরপুরের ১ নম্বর বাউনিয়া মৌজায় ২৪৭.৫ শতাংশ জমিতে টিনশেড বাড়ি, একই মৌজায় ২.৫ কাঠা জমি, সাভারের বিরুলিয়া মৌজায় ১৫ শতাংশ জমি, ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি মৌজায় চরপশ্চিম টেপাখোলায় আট শতাংশ জমি, একই মৌজায় চর পশ্চিম টেপাখোলায় ৯ শতাংশ জমি, এই মৌজায় আরও ৫.৩০ শতাংশ জমি, ঢাকার কেরানীগঞ্জে খাজা সুপার মার্কেটের দোতলায় একটি দোকান, ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি মৌজায় হাবেলী গোপালপুরে পাঁচ শতাংশ জমিতে নির্মাণাধীন দোতলা বাড়ি, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পের কাঠালদিয়ায় ছয় কাঠা জমি, হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের ২০০০ সিসির একটি গাড়ি (মডেল নম্বর ২০১৪, ইঞ্জিন নম্বর ৩তজ-ই৩৬৭৫০২)।

বিদেশে সম্পদ : আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনার নামে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি বাড়ি রয়েছে। বাড়িটি তার দূর সম্পর্কের মামা বদিউর রহমান দেখাশোনা করেন। বদিউরের বাড়ি রাজশাহীতে। বাড়িটি রাজধানীর বনানীর জনৈক লোকমানের সহায়তায় হুন্ডির মাধ্যমে দুই লাখ ডলারে কিনেছেন তারা। তাদের নামে মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

নিম্ন পদে চাকরি করেও আবজাল নিজে ও তার পরিবারের সদস্যরা অনেকবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়েছেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন।

আবজালের ইতিবৃত্ত : আবজালের বয়স এখন ৪৫ বছর। ১৯৯২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সেখানেই লেখাপড়ার ইতি টানেন। এরপর গ্রামে রাখি মালের (মজুদ করে পরে বিক্রি) ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে (ফরিদপুর, কুমিল্লা, খুলনা, দিনাজপুর ও বগুড়া) অস্থায়ীভাবে ‘অফিস সহকারী’ পদে যোগদান করেন। প্রকল্পটি ২০০০ সালে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ‘অফিস সহকারী’ পদে পাঠানো হয়। এরপর তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি করা হয়। সেখান থেকে ঢাকার মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি। সম্প্রতি তাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে বদলি করা হলে তিনি দুই মাসের মধ্যে আবার ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। সর্বশেষ তিনি ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। এরই মধ্যে তাকে এই পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

রুবিনার ইতিবৃত্ত : রুবিনা খানমের বয়স এখন ৩৯ বছর। পাঁচটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে (ফরিদপুর, কুমিল্লা, খুলনা, দিনাজপুর ও বগুড়া) ১৯৯৮ সালে তিনি স্টেনোগ্রাফার পদে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। দুই বছর পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন রুবিনা। ২০০৫ সালে আগস্ট মাসে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স করান তিনি।

Print Friendly

Related Posts