ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান

আফরোজ রিমি
বাঙালির জীবনে যে সব রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অধিকার সচেতন করে তার মধ্যে অন্যতম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এই ঘোষণা জিন্নাহকে বাঙালীর কাছে ঘৃণিত শাসকের ভূমিকায় চিহ্নিত করে। তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হিসেবে স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনের নতুন মেরুকরণ করে। রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস গৌরবময়। মফস্ফল থেকে আসা একদল ছাত্র এ আন্দোলনের গতিধারা পৌঁছে দেয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যশোর জেলার মহকুমা শহর মাগুরা। মাগুরায় ভাষা আন্দোলন ব্যাপক জনমত তৈরি করে। সেদিন তরুণ ছাত্র নেতৃত্ব নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, জলিল খান, মীর্জা শওকত হোসেন, হামিদুজ্জামান এহিয়া মাগুরা, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টার লিখন, লিফলেট বিতরণ ও বক্তৃতা দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনসংযোগ তৈরি করেন। এদের সঙ্গে যুক্ত ছিরেন জোয়ার্দার আব্দুর রহিম।
ছাত্র নেতৃত্ব। গভীর রাত জেগে বেলুচ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপন বৈঠক করতে হতো। অথচ ইতিহাসে এই মুখগুলোসহ অনেক মুখই অন্ধকারে থেকে গেছে। । আমরা ভাষাসৈনিকের জীবন কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
মাগুরা জেলার এক ভাষাসৈনিক একেএম হামিদুজ্জামান এহিয়া ১৯ আগস্ট ২০০৬ ইন্তেকাল করেন। ১৯৩৮ সালের ১৪ জুলাই মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল গ্রামে হামিদুজ্জামান এহিয়া জন্মগ্রণ করেন। মাগুরা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও হোসেন শহীদ সোররাওয়ার্দী কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে তিনি প্রথমে শিৰাকতা ও পরবর্তীতে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ঢেউ মফস্বলে পৌঁছুলে হামিদুজ্জামান এহিয়া ছাত্র সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল ছাত্র তাঁর কাছে কেন্দ্রীয় নির্দেশ পৌঁছে দিতেন। মাগুরা জেলার অভ্যন্তরে তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশ করতেন। তাঁকে সরকারী কোপানলে পড়তে হয়। ১৯৫৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলুচ আর্মড পুলিশের হাতে মাত্র ষোল বছর বয়সে গ্রেফতার হন। তাঁকে থানা হাজতে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে থানা হাজতে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মাগুরায় স্থানান্তরিত করা হয়।ভাষা আন্দলনে গ্রফতার হওয়ার কারণে নাকোল রাইচরণ স্কুল থেকে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
 বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দিয়ে তিনি মাগুরার  প্রতিনিধিত্ব করেন। ভাষা সৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়ার কৃতিত্বপুর্ণ অবদানের কারণে ভাষা আন্দোলন গবেষনা কেন্দ্র,ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম, সাপ্তাহিক সমধারা, কবি সাহিত্যিক ঐক্যজোট সহ অসংখ্য সংগঠন  তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেছে। তার গৌরবময় ভুমিকার কথা গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে “যারা অমর ভাষাসংগ্রামে” “ভাষাসংগ্রামের স্মৃতি” “একুশ” প্রভৃতি গ্রন্থে। এই কৃতী ভাষাসৈনিকের নামে মাগুরার নাকোল কেষ্টপুর সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।    তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কারণে তিনি জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য ও আশীর্বাদ লাভ করেন।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরিণত মুহূর্তে পর্যন্ত হামিদুজ্জামান এহিয়া সরকারী চাকরির পাশাপাশি দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে এই ভাষাসৈনিকের অবদান মাগুরা অঞ্চলে বেশি।  হামিদুজ্জামান এহিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর নেতৃত্বের কাছে অভ্যন্তরের খবর যেমন পৌঁছে দিতেন, তেমন অস্থায়ী সরকারের নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন ও গোপন তৎপরতার লিয়াজোঁ অক্ষুণ্ন থাকত তাঁর মাধ্যমে। সাংসারিক দায়িত্ব বয়োবৃদ্ধ পিতা, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা ও উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করতে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। ভাষাসৈনিক হিসেবে বাড়তি সুযোগ তিনি গ্রহণ করেননি, বরং সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষা প্রদান করার পথ প্রশস্ত ও স্বাবলম্বী করার জন্য তিনি ও তার বিদুষী স্ত্রী মাহমুদা মির্জা (অবসরপ্রাপ্ত শিৰিকা) প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।
তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিশেষ পরিচিত কলাম লেখক সাইফুজ্জামান, ড. সাইদুজ্জামান, ড. হাদিউজ্জামান।কলামিস্ট, লেখক, সাগর জামান । মেয়েদের মেধ্য খ্যাতিমান তাসলিমা জামান শিল্পী (চিত্র শিল্পী), জান্নাতুল ফেরদৌস শিখা, রিংকী জামান কেকা।
পিতার স্বপ্নের পথ ধরে সন্তানেরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়া যেমন গিয়েছিলেন তাঁর পিতা, এএফএম কামরম্নজ্জামান (বাসি মিয়ার) স্বপ্নের দিকে। ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়া আজ আমাদের কাছে স্মৃতির মানুষ। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাগুরা জেলার নাকোল সম্মিলনী কলেজ। নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পিতার কবরের পাশে চির বিশ্রামে শায়িত তিনি স্বজনদের কাছে প্রিয়তম পিতা, শ্বশুর, ভাই ও পরমাত্মীয়।
হামিদুজ্জামান এহিয়া যে স্বপ্ন দেখতেন তা কী পূরণ হবে? ঘরে ঘরে সৎ প্রতিবেশী হিতাকাঙ্ৰী পরোপকারী মানুষ আজ হারিয়ে যাচ্ছে তাই ভয় হয় ভীষণ।
লেখক : শিক্ষিকা
Print Friendly

Related Posts