বাংলা ভাষা দেশের সর্বস্তরে ব্যবহার করা হোক

মোকাম্মেল হক মিলন

‘বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা চাই’ এ দাবীতে ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ব পকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বুকের রক্ত দিয়েছিলেন। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা অসংখ্য মানুষ সেদিন ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দূ ভাষাকে রাষ্টভাষা হিসেবে পরিনত করতে পারেনি, পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আর পূর্ব পাকিস্তান বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছিল।

ভাষার প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে বিশ্বে এমন আন্দোলন কখনো দেখেনি। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হয়েছে, বাঙালিকে রাষ্ট্রীয় চেতনায় জাগরিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলার সন্তানরা ভাষার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রমান করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ৬৭ বছর আগের সেই চেতনা বাংলা ভাষা বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে।

৫২’র চেতনার হাত ধরে স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছি এই বাংলার মানুষরা। বাঙালি জাতি সেই স্বাধীনতার বিজয়ের উল্লাস আর ভাষার আবেদন তবে কি পরাভুত ? ঔপনেবেসিক যুগে চাপিয়ে দেয়া ইংরেজী শিখতে আমরা এতই গর্ববোধ করি যে, আমাদের জাতীয়তাবোধ, দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমে আনুসারিক শক্তির নীচে চাপা পড়ে গেছে কি ?

বর্তমান প্রজন্মকে (সন্তান) দের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর ঢাকার এক মায়ের উক্তি “আমার ছেলেতো বাংলা পড়তেই পাড়ে না এবং বাংলা পাড়ার চেষ্টও করেনা” এ কথাটি বলার সময় মায়ের চেহারায় যে দ্যুতি দেখেছি তা কখনোই ভোলার নয়। নিজে সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি অবহেলা কোন ব্যক্তিকে তার ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনে মহতি অবদান রাখতে সাহায্য করবে কি না তা ভেবে দেখা দরকার।

কোন সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে গবেষণার মূল বিষয়বস্তু প্রাধান্য না পেয়ে প্রাধান্য পায় Is, Am, Are, Preposition এর সঠিক প্রয়োগের বিষয়টি তাই শুধু ইংরেজিতে গবেষণাপত্র প্রকাশের বাধ্য বাধকতা দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠিকে গবেষণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। ৬৭ বছরেও এখনও দেশের সকল অফিস-আদালতে ইংরেজি প্রচলন রয়েছে। দ্রুত ইংরেজি প্রচলন বন্ধ করে বাংলা প্রচলন সর্বস্তবের চালু রাখা একান্ত প্রয়োজন।

আমি ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করছি না। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম ভার্সণে পড়া জনগোষ্ঠির সংখ্যা অত্যান্ত কম হওয়ায় দেশের ভেতরে গবেষণা নিবন্ধনগুলো মাতৃভাষা বাংলায় প্রকাশ করার সুযোগ থাকা উচিত বলে মনে করছি। এতে জ্ঞান নির্ভর অর্থনৈতিকে দেশের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠির অংশগ্রহণে সুযোগ নিশ্চিত হবে বলে বিশ্বাস করি।

অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক, অহিংস আমাদের আবহমানকালীন ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ও চেতনার আবিস্কার করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও কবিতায় তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আইকন। তিনি বলেছেন, হিন্দু না মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ? বল, ডুবিয়েছে মানুষ, সন্তান মোর মার। বাংলার এই জনপদে আবহমানকাল ধরে ইতিহাসে এক সামাজিক সম্প্রীতির সুখি-সমৃদ্ধ দেশ ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ অশান্ত, শান্তি বিঘ্নিত, অস্থিরতা, উত্তেজনা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গি ও উগ্রবাদের উন্মাদনা, সামাজিক সংঘাত, ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠিগত ঘৃণ্য সহিংসতা, হানা-হানি, সন্ত্রাসবাদের বল্গাহীন বিস্তার, শান্তি ও সম্প্রীতি সুদূর পরাহত। স্থিতিশিলতা বিপদজনকভাবে বাঁধাগ্রস্ত। নীতি মূল্যবোধের শূন্যতা, হিংসা উন্মুত্ত বাংলাদেশ, উগ্র লোভ-লালসায় মানুষ উন্মুত্ত।

এ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবাইকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মা, মাতৃভ‚মি ও মাতৃভাষার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ও প্রবল ভালোবাসায় মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য ইতিবাচক শক্তির জন্ম হোক, যা মানুষের যে কোন বিষয়ে সফলকাম করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, অমর একুশে মাতৃভাষার টান, জাতির জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে হবেই। তাই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সেই শিক্ষার্থীদের জন্য মায়ের ভাষা বাংলা প্রচলন রাখার মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের ভাষা নিয়ে গর্ব। সেই গর্বের ভাষার এ পরাজয় থেকে মুক্ত করতে সর্বস্তরের বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি করে একুশের অমরকে গর্বিত জাতির পাতায় লিপিবদ্ধ থাকুক, এই হোক আগামীর প্রজন্মের জন্য আমার ভাবনা।

Print Friendly

Related Posts