বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ২৫শে মার্চ রাতে চট্টগ্রামে পৌঁছায়

মুসা সাদিক

স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শুক্রবার দুপুর পৌণে দুইটায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু করে আমি এই বেতারের একজন ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সপ্তাহে দু’বার “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” ও “মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম” দুটি কথিকার প্রচারক হিসেবে দেশবাসীর কাছে আমি কিছু সত্য তুলে ধরতে চাই।

১৯৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আমার অগ্রজ মোহাম্মদ আবু জাফর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার পদে অধ্যাপনা করার কারণে (পরবর্তীকালে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আমি ও আমার আরও দু’ভাই ডঃ মোহাম্মদ ইসা (বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক) এবং জনাব মোহাম্মদ মহিউদ্দিন (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক) একত্রে চট্টগ্রামের কাজেম আলী রোডে বসবাস করতাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি দৈনিক ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা এবং দৈনিক আজাদীর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতাম।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে রিলে করার সরকারী ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা রিলে না করায় সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামবাসীও বিক্ষোভে ফেটে পড়লো রাস্তায় রাস্তায়। সারাদিন ও সারারাতভর চট্টগ্রামে গগণবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুললো “বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। ৮ই মার্চ আকস্মিকভাবে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ভাষণ প্রচার করা হলোঃ

হাজার বছর ধরে নির্যাতিত বাঙালী জাতি যে মহামানবের দেখা পাবার জন্যে অশ্র“সিক্ত নয়নে আলাহর কাছে ফরিয়াদ করে এসেছে ’৭১-এর ৭ই মার্চ হিমালয়ের মতো সেই মহামানব তাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও সঙ্গীতের সুর ধ্বনিত মথিত হয়ে উঠলো তার কন্ঠেঃ “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষণার পর থেকে চট্টগ্রামের বীর জনগণ চট্টগ্রামে মূলতঃ স্বাধীন রাষ্ট্রের অফিস আদালত চালু করে দিয়েছে। ছাত্র-জনতা-শিল্পী-সাহিত্যিক সকল পেশাজীবি মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নেতে পড়লেন। ১২ই মার্চ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক আবুল ফজলের বাসায় শিল্প-সাহিত্যিকদের সভা হলো। সেখানে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, সর্ব জনাব রশীদ চৌধুরী, দেবদাশ চক্রবর্তী, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক অনুপম সেন, মোহাম্মদ রফিক, শ্রী নীরোদ বরণ বড়ূয়া, বেলায়েত আলী খান, ডঃ কামাল এ খান (চট্টগ্রাম পোর্ট), শ্রী হরিপাল, গায়িকা রাজিয়া শহীদ, রুখসানা আহমদ, সেলিম আহমদ, মতিউল ইসলাম এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর ও আমি সহ অনেকে উপস্থিত ছিলাম। সভায় সমগ্র চট্টগ্রামব্যাপী পথসভা, গণসঙ্গীত এবং মমতাজ উদ্দিন সাহেবের স্বাধীনতার নাটক মঞ্চায়ন করার সিদ্ধান্ত হলো। এই সমগ্র কর্মকান্ডে আমার বড় ভাই ও আমি সক্রিয়ভাবে স¤পৃক্ত হলাম। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী আমাকে সহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের তার বাটালী হিলের বাড়ীতে এ সময় বললেন যে, “বি ডি আর ও পুলিশের বাঙালী অফিসারদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা আমাদের সঙ্গে আছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তিনি আমাদের সার্বক্ষণিক নির্দেশ দিচেছন। আপনাদের কাজ চালিয়ে যান”।

২৪শে মার্চ দৈনিক আজাদী লিখলো যে, পোর্ট ট্রাষ্টে গুলিতে ৩ জন বাঙালী হত, ৪ জন আহত। পিপলস ভিউ লিখলো ৩/৪ জন হত। ঐদিন প্যারেড গ্রাউন্ডে গণজমায়েত, গণসঙ্গীত ও অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিনের নাটক “এবারের সংগ্রাম” মঞ্চায়িত হলো। সভাপতিত্ব করলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ এ আর মলিক। প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী।

আগের দিনের মতোই মিটিং মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠে সমগ্র বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। তবে ২৪শে মার্চ রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থিত পাকিস্তানী নৌ-বাহিনীর জাহাজ থেকে চট্টগ্রাম শহরের দিকে বহু গোলা ছোড়া হয়। সেই গোলার শব্দে ও আলোয় চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ পশ্চিমের একাংশ আলোকিত হয়ে ওঠে। ফলে ২৫শে মার্চ চট্টগ্রামের অবস্থা থমথমে হয়ে ওঠে। কিন্তু দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীর বাসায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠকে যে কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ক্যান্টনমেন্টের চারপাশে এবং পোর্টের মেইন রোডগুলোর ওপর বেরিকেড দেবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল তরঙ্গের মতো জনগণ নেমে পড়ে এবং ২৫শে মার্চের দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে আসার দিকে নাসিরাবাদ, বায়জিদ বোস্তামী ও অক্সিজেনের মোড়সহ ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত সকল সড়ক মহাসড়ক বেরিকেডে অবরুদ্ধ হয়ে যায়।

অপর প্রান্তে চট্টগ্রাম পোর্টে পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্র নিয়ে আগত জাহাজ সোয়াত থেকে যাতে কোন অস্ত্র খালাস হয়ে ক্যান্টনমেন্টে না পৌঁছাতে পারে সেজন্য পোর্ট থেকে শহরমুখী সকল সড়ক মহাসড়কসহ আগ্রাবাদ-ষোল শহর-কালুরঘাট এলাকা জনতার বেরিকেডে পুরাপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে চট্টগ্রামের বীর জনগণ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম পোর্টকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ও অবরোধ করে ফেলে। জহুর আহমদ চৌধুরী,  এম এ হান্নান ও এম এ মান্নানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বীর শ্রমিক নেতারা এবং এস এম ইউসুফ, মহীউদ্দিন চৌধুরী, আবদুর রব (একাত্তরের শহীদ), জামাল প্রমুখ ছাত্রলীগের নেতারা মাষ্টারদা সূর্যসেনের ঐতিহ্যের চট্টগ্রাম কার্যত দখল করে ফেলে।

২৫শে মার্চের দুপুরে চট্টগ্রামে ইপিআর-এর মেজর রফিক তাঁর সমন্বয়কারী ছাত্রনেতা বখতিয়ার নুর সিদ্দিকীর মাধ্যমে ছাত্রনেতাদের কাছে “মেসেজ” পাঠান যে সিআরবিসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার ফোর্স সিক্রেট পজিশন নিয়ে ফেলেছে। এ সময় ছাত্রনেতা আবদুর রব (শহীদ), ইউসুফ, মাহবুবুল হক, আবু তাহের, মহীউদ্দিন চৌধুরী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান প্রমুখ ইপিআর ফোর্সের পজিশনে খাবার, পানি এবং অন্যান্য লজিষ্টিক সাপোর্ট পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত নেন।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের ওপর যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা আকস্মিক হামলা করে তা মোকাবেলার জন্য ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং ছাত্রনেতা আবদুর রব ও ছাত্রলীগের অন্যান্য শীর্ষ নেতারা গোপনে বৈঠকে বসেন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করার বিষয়ে উক্ত বৈঠকে বেশ কিছু গোপন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আগরতলা বি এস এফ-এর কাছে জরুরী চিঠি দিয়ে বিএসএফ-এর থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক থ্রি নট থ্রি সহ হালকা অন্যান্য অস্ত্র আনার গোপন সিদ্ধান্তও উক্ত বৈঠকে নেয়া হয়েছিল এবং পরদিনই লোক চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মর্মে এম আর সিদ্দিকী আমেরিকায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হয়ে যাবার আগে আমার কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেন।

২৫শে মার্চ সারাদিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে রাত এগারটার দিকে কাজেম আলী রোডের বাড়ী ফিরে কিছু খেয়ে আমার বড় ভাই ও আমি দৈনিক আজাদী অফিসে গেলাম রাত একটার দিকে। আমাদের বাড়ী থেকে ১০/১২ টা বাড়ী পরেই দৈনিক আজাদী অফিস। আমরা সেখানে হেঁটে গেলাম। দৈনিক আজাদী অফিসের দোতলায় আমরা সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমপি সাহেবের কাছে গেলে তিনি ঢাকা থেকে তৎক্ষণাৎ টেলিপ্রিন্টারে আসা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত ইংরেজী টেক্সট দেখালেন এবং বললেনঃ “জাফর সাহেব দেখেন ঢাকায় ম্যাসাকার (গণহত্যা) হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন আমাদের সামনে আলজেরিয়া ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘ স্বাধীনতার যুদ্ধ।” রাত তখন ১টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ সেটা তখন ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহর। আমিও পড়লাম সেই টেলেক্স মেসেজ। টেলেক্স মেসেজটি আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিলাম। মেসেজটি ছিল নিম্নরূপঃ

“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. Sheikh Mujibur Rahman.”

সেটা পড়ে সেখানে উপস্থিত আমাদের সকলের শরীরে শিহরণ জাগলো। প্রত্যেকে উলাসের সাথে বলতে লাগলোঃ “হাজার বছরের বাঙালী আজ থেকে চিরদিনের জন্য স্বাধীন হয়ে গেল”।

দৈনিক আজাদী অফিস থেকে আধঘন্টা পরে যখন আমরা বেরিয়ে আসলাম তখন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির (বর্তমানে কর্পোরেশন) সামনে ও আন্দরকিলায় ঐ গভীর রাতেও দেখলাম বহু মানুষের জটলা। তারাও শুনেছে ঢাকায় পাক বাহিনীর আক্রমণ ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। তারা অনেকেই বলাবলি করছিল যে, ঢাকার সাথে টেলিফোন কানেকশন পাওয়া যাচেছ না।

২৬শে মার্চ রাত দুটোর দিকে বাসায় ফিরে এলাম। রাত ৪টায় মাইকের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমাদের কাজেম আলী রোডের বাড়ীর তিন তলা থেকে আমার বড় ভাই, আমি আমার ছোট দুই ভাই ইসা ও মহীউদ্দিন নিচে নেমে এলাম মাইকে কি বলা হচেছ শোনার জন্য। আমি ও বড় ভাই দৈনিক আজাদী অফিসের দিকে পা বাড়ালাম, তখনো অন্ধকারের রেশ কাটেনি। সেখানে গিয়ে দেখলাম মিউনিসিপ্যালিটির সামনে আন্দরকিলায় মাইকিং হচেছ যে, “ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আপনারা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ূন। ঢাকায় পাক হানাদারেরা বাঙালী ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্রদের হত্যা করেছে। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙালী রুখে দাঁড়াও”— মাইকের এই ঘোষণা শুনে আমাদের মতো ঘর ছেড়ে বহু লোক দলে দলে আন্দরকিলার রাস্তায় নেমে আসে এবং গগণবিদারী “জয় বাংলা” শোগান দিয়ে উলাস করতে থাকে। সকাল ন’টার দিকে আন্দরকিলা এবং লালদীঘি মানুষে ভরে যায়। তাদের অনেকের হাতে বন্দুক, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, দেশী বলম ও লাঠিসোটা। ছাত্র-জনতার মধ্যে অনেক পুলিশ ও বাঙালী ইপিআর-কেও দেখলাম।

লালদীঘি থেকে আন্দরকিলায় সকাল সাড়ে ন’টার দিকে ফিরে দেখলাম অধ্যাপক ডঃ অনুপম সেনের শ্বশুর বাড়ীর সামনের হোটেল ডি, সিটিতে এক প্রচন্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে দেখলাম সাইক্লোষ্টাইল করা বাংলায় লেখা একটি কাগজ বিলি করা হচেছ। খুব কষ্ট করে একটা কাগজ নিলাম, দেখলাম কাল রাতে দৈনিক আজাদী অফিসে দেখা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজী টেক্সট-এর বঙ্গানুবাদ। আমিও আমার সাথী হাফিজ সেটা পড়লাম। সেখানে একজন অনুরোধ করে বললেনঃ “আঁয়ার বাড়ীর রাউজান। আঁই কাগজ খান ন’পাই। আঁয়ারে ইয়ান দেওন। আঁই ইয়ান রাউজানত লাই যাঁইউম”। যেহেতু এটা আমি কাল রাতে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমপি সাহেবের হাতে দেখেছি এবং এটার ইংরেজী ভার্সান আমার কাছে লেখা আছে সেজন্য আমার সেটা তাকে দিয়ে দেই। ওখান থেকে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভা হচেছ শুনে সেখানে গেলাম। সেখানে দেখলাম দুই তিন হাজার ছাত্র-জনতার সমাবেশে তদানীন্তন ছাত্রলীগের শীর্ষনেতা এস এম ইউসুফ আন্দরকিলায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার যে লিফলেট বিলি করা হচিছল, তা হাতে নিয়ে সমবেত জনতাকে পড়ে শুনাচ্ছেন এবং বক্তৃতা করছেন। সেখানে দি পিপল এর এক সাংবাদিক বললেন যে, কাল রাতে পাহাড়তলী অয়ারলেস অফিসের ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার মোঃ নুরুল আমিন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ রিসিভ করেন। সেখান থেকে জনাব আমিনের ভাই নন্দন কানন অয়ারলেস অফিসের অয়ারলেস অপারেটর এবং “স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের” চট্টগ্রাম টিএন্ডটি’র মহাসচিব মাহতাব উদ্দিনকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ তৎক্ষণাৎ দিয়ে দেন। মাহতাব উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের বেঙ্গল রেজিমেন্টকে উক্ত মেসেজ দিয়ে দেন। আওয়ামী লীগ নেতারা উক্ত অয়ারলেস মেসেজের কপি নিয়ে সারা শহরে বিতরণ করেছেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সেই কাগজ এখানে বিলি হচেছ। সাংবাদিকের মুখে একথা শুনে জনা নুরুল আমিন ও মাহতাব উদ্দিনকে দেখতে অনেকেই গেল নন্দন কানন ও পাহাড়তলী অফিসের দিকে।

২৬শে মার্চ ভোর ৫টায় দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আমাকে তাঁর সিরাজউদ্দৌলা রোডের বাসায় আসতে বলেন। ওঁনার বাড়ী এবং আমাদের কাজেম আলী রোডের বাড়ী পাঁচ মিনিটের দুরত্ব ছিল। ওঁনার বাসায় গেলে তিনি একটি গাড়ীতে আমাকে ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বড় ছেলেকে পাঠালেন আসকার দিঘীর পাড়ে চট্টগ্রাম রেডিও’র আঞ্চলিক পরিচালক নাজমুল আলম সাহেবকে নিয়ে আক্তারুজ্জামান বাবুর পাথরঘাটার জুপিটার হাউজে আনতে। আমরা গিয়ে ওঁনাকে পেলাম না। শেষ রাতে তিনি বাসা ছেড়ে গেছেন। খালেদ মোহাম্মদ সাহেবের নির্দেশ মতো ওখান থেকে আমরা গেলাম চট্টগ্রাম রেডিও’র বার্তা সম্পাদক সুলতান আহমদের আগ্রাবাদ কলোনীর বাসায়। সেখানে গিয়ে তাঁকে পেলাম না। সেখান থেকে আমরা আগ্রাবাদে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেডিও অফিসে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম ঢাকার রেডিও থেকে যেসব সামরিক নির্দেশাবলী জারী হয়েছিল, সেগুলো চট্টগ্রাম রেডিও’র দেশপ্রেমিক অফিসাররা প্রচার করতে না দিয়ে রেডিও বন্ধ করে চলে গেছেন। ঢাকার সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যারা এই বিদ্রোহের কাজ করেছেন, সেই মহান মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, চট্টগ্রাম রেডিও’র ইঞ্জিনিয়ার আবদুর শাকের, প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আনোয়ার, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট রাশেদুল হাসান, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট শরফুজ্জামান, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট আমিনুর রহমান প্রমুখরা।

সেখানে অবস্থানরত গার্ডদের কাছে জানাল যে, আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ নেতা এম এ হান্নান, এমএনএ সকালে সেখানে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী প্রচার করতে। কিন্তু রেডিও বন্ধ থাকায় তিনি আগ্রাবাদ কলোনী অবস্থিত রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহানের বাসায় গেছেন। সেখানে গিয়ে জানলাম এম এ হান্নান, এমএনএ জনাব সোবহানকে নিয়ে কালুরঘাটে গেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে। আগ্রাবাদ কলোনীতে রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুর শাকের এর সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি বললেন যে, তাঁর অন্যান্য সহকর্মী শরফুজ্জামান, রাশেদুল হাসান এবং আমিনুর রহমানদের নিয়ে তাঁরা কালুরঘাটে যাচ্ছেন এবং সেখান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রচার শুরু করবেন।

আমরা সেখান থেকে ফিরে জুপিটার হাউসে আসি এবং সম্পাদক সাহেবসহ সকল নেতাকে দেখতে পাই। তাঁকে জানাই যে, এম এ হান্নান সাহেব, রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান সাহেবকে নিয়ে কালুরঘাটে গেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে। যথার্থই দুপুর থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের ভিপি ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের নেতা আবুল কাশেম সন্দ্বীপ-এর কণ্ঠস্বরে চট্টগ্রামবাসী প্রথম শুনতে পেলেন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”।

“বিপ্লবী” শব্দটি স্বাধীন বাংলা বেতারের নাম থেকে ২৭শে মার্চ বর্জন করা হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে। কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার সহ সমগ্র চট্টগ্রাম এবং যেমন সমগ্র বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী চলছিল।

আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কন্ঠে বেতারের নাম তিনবার ঘোষণার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এম এ হান্নান, এমএনএ-এর নাম ঘোষণা করে বলা হলো তিনি এখন একটি বিশেষ ঘোষণা দেবেন। জনাব হান্নান তাঁর জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর উক্ত স্বাধীনতা ঘোষণা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচার করে শোনালেন। তিনি বললেন, “গতকাল ২৫শে মার্চ রাতে খুনী টিক্কা খান ও হানাদার পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানায় ইপিআরদের ওপর এবং রাজারবাগে বাঙালী পুলিশের ওপর কামান বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা এবং সমগ্র বাঙালী জাতির একমাত্র নেতা। বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ঘোষণা করেছেন এবং বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন দেশ। প্রতিটি বাঙালী ভাই-বোন যে যেখানে আছেন, হানাদার পাক বাহিনীকে খতম করুন। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করুন। ঢাকা থেকে প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর এটাই শেষ বার্তা ও ঘোষণা। ঢাকার সাথে আমাদের আর কোন যোগাযোগ নেই। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। বাঙালী বীরের জাতি। এই যুদ্ধে জয় আমাদের হবেই। বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে আছেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচেছন এবং খুনী টিক্কা খান ঢাকায় বাঙালী কমান্ডোদের হামলায় নিহত হয়েছে। পৃথিবীর যে যেখানে বাঙালী আছেন, সবাই আমাদের সাথে থাকুন। বাংলাদেশ সকল দেশের সাহায্য চায়। সকল জাতির সমর্থন চায়। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।”

২৫শে মার্চ দুপুর পৌণে দুইটায় জনাব এম এ হান্নানের কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর উক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর থেকে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠস্বরে থেমে থেমে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে সারা বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হতে থাকে।

বিকেলে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক খালেদ মোহাম্মদ-এর বাড়ীতে আমি গেলাম। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যাবেন কিনা, গেলে কখন যাবেন তা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তিনি জুপিটার হাউজে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা সেখানে আছেন। তাঁর সাথে সেখানে গেলাম সেখানে আমি কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারে যাবার জন্যে কেউ আগ্রহী কিনা এবং একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে অনেককে বললাম। চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা এস এম ইউসুফ এবং আরো কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী আমার অনুরোধে সাড়া দিলেন। এস এম ইউসুফ সহ আমরা বিকাল চারটার দিকে জুপিটার হাউজ থেকে একটি জীপে করে কালুরঘাট রওয়ানা হলাম। জীপটি সম্ভবতঃ আক্তারুজ্জামান বাবুর ছিল। সেখান থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পৌঁছালাম তখন সেখানে বেতারের ঘোষক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মুসলিম খান, রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান এবং মেকানিক শুকর আলীর সাথে আমাদের দেখা হলো। আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কাছে এস এম ইউসুফ অনেক বড় নেতা। সন্দ্বীপ বললেন, “ইউসুফ ভাই, আপনি কিছু স্বাধীন বাংলা বেতারে বলুন”। এস এম ইউসুফ তাঁকে প্রায় ধমকই দিলো। তিনি তাঁকে বললেন যে, “বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অব্যাহতভাবে প্রচার করতে থাকেন। হান্নান ভাইসহ আমাদের বড় নেতারা আবার আসবেন। তবে সেনাবাহিনীর কোন অফিসারকে দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে কিছু বলানো দরকার। যাতে করে দেশবাসী বুঝতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে বাঙালী সেনা অফিসাররাও আছেন। আমাদের নেতা এম আর সিদ্দিকী সাহেব ইপিআর-এর মেজর রফিককে পাঠানোর চেষ্টা করছেন, তাঁকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচারের জন্য।” আমরা কালুরঘাট থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম ফিরে আসি। তখন থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতারা সশস্ত্র বাহিনীর কোন অফিসারকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের নির্দেশ দেয়। সেই মুহুর্তে ইপিআর-এর মেজর রফিক তাঁর ফোর্স ও পুলিশ বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম শহর তাঁর কব্জায় রেখেছিলেন এবং কালুরঘাট থেকে দূরে ছিলেন। অপরদিকে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া কালুরঘাটের সন্নিকটে ছিলেন।

২৭শে মার্চ বিকেলে রেডিও চট্টগ্রাম রেডিও’র রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুর শাকের, প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আনোয়ার, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট রাশেদুল হাসান, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট শরফুজ্জামান স্ক্রীপ রাইটার বেলাল মোহাম্মদ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারে গিয়ে যোগদান করেন। ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেন। আওয়ামী লীগ নেতারাও মেজর জিয়ার কাছে তাদের নির্দেশ প্রেরণ করেন। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানান বেলাল মোহাম্মদ, ইঞ্জিনিয়ার আবদুর শাকের প্রমুখরা মেজর জিয়াকে হাসতে হাসতে বলেন, “মেজর সাহেব, আমরা এখানে সবাই মাইনর। আপনি একমাত্র মেজর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের একজন মেজর হিসেবে আপনি স্বাধীন বাংলা বেতারের বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটা প্রচার করে দিন। আপনার ঘোষণায় যে সমস্ত পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বাঙালী সৈনিকরা এখনো বুঝতে পারছে না, তারা বুঝে যাবে যে, সকল বাঙালী সৈনিক, পুলিশ ও ইপিআর-রা এই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেছেন…….।”

৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় স্বাধীন বাংলা বেতারে বঙ্গবন্ধুর নামে ও পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, এই তার পটভূমি।

কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি ছিল ১০ কিলোওয়াটের এবং তার কভারেজ এরিয়া ছিল ৫০/৬০ কিলোমিটার এরিয়া। এই কালুরঘাটে ৩০শে মার্চ দুপুর দুইটার সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনী এয়ার স্টাপিং করে। সেই মুহুর্তে আমি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি আবদুর রব এবং চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা এস এম ইউসুফ একটি জীপে করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যাচ্ছিলাম। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২/৩ মাইল দূরে থাকতে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওপর পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর তিনটি বিমানের চক্রাকারে এয়ার স্টাপিং দেখতে পাই। ইউসুফ ভাইয়ের সংগ্রহ করা উক্ত গাড়ীর ড্রাইভার সর্বাগ্রে তা দেখতে পায় এবং রাস্তার পাশে একটি ঝোপের মধ্যে গাড়ী ঢুকিয়ে দেয়। আমরা তৎক্ষণাৎ গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে ঝোপ-ঝাড়ের ভেতরে নিজেদের আড়াল করি। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আক্রমণ মুহুর্তে বেতারে অবস্থিত সবাই দৌড়ে আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের পর স্বাধীন বাংলা বেতার অচল হয়ে যায়। আমরা তীব্র গতিতে চট্টগ্রাম শহরের দিকে বিকাল সাড়ে তিনটায় ফিরে আসি। পরদিন ৩১শে মার্চ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি-রা সহ আমরা কালুরঘাটে ফিরে এসে দেখি যে, কালুরঘাট বেতারের এন্টেনার ম্যাচিং পয়েন্ট সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেটা খুলে নিয়ে মদনঘাটে নিয়ে মেরামতের চেষ্টা করা হলো। কিন্তু মেরামত সম্ভব না হওয়ায় কালুরঘাটে ফিরে এসে ১ কিলোওয়াটের একটি মিডিয়াম ওয়েভ-এর ট্রান্সমিটার ছিল, সেটা নিয়ে তারা পটিয়া গেলেন। সেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তাদের সাথে ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার নিয়ে আমরা বেলুনিয়া পার হয়ে ভারত সীমান্তের ভিতরে চলে গেলাম এবং সেখান থেকে ৪ঠা এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রচারণা পুণরায় শুরু করলাম। যার প্রচার এলাকা ছিল ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার। এখান থেকে আমি স্বকণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারে অন্যান্যদের সাথে প্রচার-প্রচারণা শুরু করি। অপরদিকে, ত্রিপুরায় ভারতের বিএসএফ স্বাধীন বাংলা বেতারের কভারেজ এরিয়া বৃদ্ধির জন্য ৬০ ওয়াট সর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার দেয়। বাঘাফা থেকে ভারতের বিএসএফ-এর নিরাপত্তাধীনে স্বাধীন বাংলা বেতার পুনরায় জোরেসোরে তার কার্যকর শুরু করল। বিএসএফ-এর কর্ণেল মুখ্যার্জি এখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ও কর্মচারীদের সকল সুবিধাদি নিশ্চিত করলেন। (কিন্তু এই বাগাফা কেন্দ্রে একটি বিপর্যয় ঘটল। বাগাফা কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল ভারতের পাঞ্জাবী বাহিনীর একটি উইং। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে “হানাদার পাঞ্জাবী” প্রচারিত হতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তাদের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তারা “হানাদার পাঞ্জাবী” শব্দ প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।) মে মাসে খবর এলো যে, ভারত সরকার বাংলাদেশকে ৫০ কিলোওয়াটের মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার দিল। যা থেকে সমগ্র বাংলাদেশ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ কভার হয়ে যায়। কলকাতার বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতারের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রচার কার্যক্রম অব্যাহতভাবে পরিচালনা করে।

১৯৮৮ সালে লাহোরে আমাকে দেয়া সাক্ষাতকারে বাংলাদেশে গণহত্যাযজ্ঞের প্রথম রক্তপিপাসু জেনারেল টিক্কা খান ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা সুস্পষ্টভাবে উলেখ করেছেন ও তার গণহত্যাযজ্ঞের সাফাই গেয়েছেন এই বক্তব্য দিয়ে যে, “মেরে কডনে দেঁড়াতে হুয়ে এক থ্রি ব্যান্ড রেডিও লা কর দিয়া আওর কাঁহা স্যার, সুনিয়ে, শেখ সাব আজাদী কা এলান কর রাহে হেঁয়। আওর মাইনে খোদ শেখ সাব কো রেডিও পর এক ফ্রিকোয়েন্সিছে Independence কা এলান করতে হুয়া সুনা। জিসকো বাগাওয়াত্ কাঁহা যা সেকতা হেঁয়। চুঁকে ম্যাঁয়ে শেখ সাব কি আওয়াজ আচিছ তেরা পেহছান তা থা। And I had no option but to arrest him” (আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি থ্রি ব্যান্ড রেডিও এনে বললো স্যার শুনুন, শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন। আমি নিজে রেডিওতে শেখ সাহেবকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে শুনলাম, কারণ, শেখ সাহেবের কন্ঠস্বর আমি ভাল করেই চিনতাম। যে ঘোষণা তখন দেশদ্রোহিতার শামিল ছিল। সেক্ষেত্রে শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আমার আর কোন বিকল্প ছিল না।) তাঁর এই সাক্ষাতকার ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ইংরেজী ও বাংলা পত্র-পত্রিকায় গত ১৪/১৫ বছর ধরে অবিরাম লিখে আসছি।

পাকিস্তানী জলাদ জেনারেলরা ঢাকায় ২৬শে মার্চ রাতে গণহত্যার কি ব্লু-প্রিন্ট তৈরী করেছিলেন এবং সেই রাতে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তা জানার এক অপূর্ব সুযোগ আমার জীবনে আসে ১৯৮৮ সালে। আমি তখন রাষ্ট্রপতির ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারী হিসেবে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি প্রেস টিম নিয়ে ঢাকা থেকে করাচি লাহোর হয়ে ইসলামাবাদে গিয়েছিলাম। বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক ‘দি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম এবং তদানীন্তন বিটিভি’র ‘আইন-আদালত’ অনুষ্ঠানের পরিচালক রেজাউর রহমান উক্ত প্রেস টিমের সদস্য ছিলেন। উক্ত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মানব ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের জলাদ টিক্কা খানকে বিশিষ্ট আমন্ত্রিত অতিথিদের আসনে উপবিষ্ট দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় কিভাবে তিনি সেই নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু করেছিলেন সেই অজানা তথ্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে আমি তার সাক্ষাতকার নিতে এগিয়ে যাই। বাংলাদেশের গণহত্যার নায়ক জেনারেল টিক্কা খানকে চোখের সামনে দেখে অজান্তে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো।
২৬শে মার্চ ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর ঐ আইসম্যান কিভাবে গণহত্যা শুরু করেছিল জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। সাংবাদিক দলের অন্য সদস্য সাপ্তাহিক “এখনই সময়” পত্রিকার সাংবাদিক এবং এডভোকেট রেজাউর রহমানকে শুধালাম সে যদি সাক্ষী হয় তাহলে টিক্কা খানের কাছে একটা ইন্টারভিউ নেবার জন্য যৌথ অনুরোধ করতে পারি। রেজাউর রহমান প্রস্তাব শুনে দু’বার ‘না, না’ করে নাছোড় বান্দা আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন।
জেনারেল টিক্কার সম্মতি মোতাবেক ইসলামাবাদের হোটেল ‘হলিডে ইন’ থেকে দুপুরের পর পরই আমরা দু’জনে রওয়ানা হই। ৩১শে ডিসেম্বর আমরা দু’জনে সন্ধ্যায় তার পাঞ্জাবের সরকারী “গভর্ণরের হাউজের” দোতলায় তার সাক্ষাতকার গ্রহনের জন্যে উপস্থিত হই। তার একান্ত সচিব গাড়ি বারান্দায় আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেলে দোতলায়। অবশ্য সিঁড়ির মুখে জেনারেল টিক্কা আমাদের দু’জনকে রিসিভ করলেন।

গভর্ণরের ড্রইং রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনকে নিয়ে তার বাবুর্চি, খানসামারা পেলায় মেহমানদারী শুরু করলেন। থরে বিথরে সাজানো লোভনীয় সুস্বাদু সব খাবার এবং হরেক রকমের ফ্রুট্স এনে তারা আমাদের সামনে রাখল। কিন্তু সেসব ফেলে আমরা আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগুতে লাগলাম। আমাদের মূল টার্গেট বাংলাদেশের ২৬শে মার্চ গণহত্যা শুরুর কারণ জানা। দীর্ঘ দু’ঘন্টা ধরে আমাদের নেয়া তার ইন্টারভিউ থেকে এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে তার বক্তব্যের অংশ বিশেষ তুলে ধরেছি মাত্র। আমি ইংরেজীতে প্রশ্ন করছিলাম এবং তিনি উর্দুতে উত্তর দিচিছলেন।

(Email: infomusabd@gmail.com, web: www.musabd.com)

Print Friendly

Related Posts