যতদিন আমরা থাকবো ততদিন উৎসব

অসিত রঞ্জন মজুমদার

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। দিনটি সকল বাঙালী জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

এই উৎসব শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে।

বৈশাখী আমেজ চারিদিকে। সর্বত্রই একটা উৎসবের আমেজ। সবাই যখন আনন্দে মাতোয়ারা নতুন বছরকে নেচে গেয়ে স্বাগত জানানোর জন্য। বৈশাখের কিছু চিরায়ত চরিত্র রয়েছে। বৈশাখ মানেই তীব্র দাবদাহ, ঝড়-তুফান, ঈশান কোণে খণ্ড খণ্ড মেঘের খেলা, মাতাল হাওয়া, থেমে থেমে মেঘের গর্জনের সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি।

আবার বৈশাখ মানেই মুক্তির জয়গান। এই বৈশাখেই প্রকৃতি নতুনভাবে জেগে ওঠে তেজদীপ্ত টগবগে ঘোড়ার মতো। সব জঞ্জাল, সব জড়া, সব দুখ, সব হতাশা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের সময় হলো এই বৈশাখ। বৈশাখ আপসহীন, তার প্রবহমানতা সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী। এ বছর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক প্রতিবাদের। নুসরাত, আবরাররা থাকুক বৈশাখের শোভাযাত্রার অগ্রভাগে, থাকুক আমাদের মনে, চিন্তা চেতনায় প্রতিবাদের এক বিমূর্ত প্রতীক হয়ে।

নতুনত্বের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর বাঙালির জীবনে আসে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে সমগ্র বাঙালি জাতি নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশায় কাঙ্খিত জীবনের লক্ষ্যে এককথায় নতুনভাবে জীবনের যাত্রা শুরু করে। একসময় গ্রামে গঞ্জে পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে (ছোট/বড়) হালখাতা উৎসবের আয়োজন করা হত। নতুন ধান বিক্রি করে কৃষকরা বিগত বছরের বকেয়া পরিশোধ করতেন নানাবিধ আচারাধির মাধ্যমে। ব্যবসায়ীরা মিষ্টিমুখ করিয়ে তাদের ক্রেতাদের কাছ থেকে বকেয়াকৃত টাকা গ্রহণ করতেন এবং পারস্পারিক হৃদ্যতার আবেশ তৈরি হতো।

বর্তমানে হালখাতা উৎসবের প্রকৃত আবেদনটা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো বেশ জোরেসোরেই এবং সেসব মেলায় গ্রামীণ সমাজে ব্যবহৃত সকল ধরনের পণ্যসামগ্রী ক্রয় বিক্রয় করা হতো। পাশপাশি ঐসব মেলা থেকে মিষ্টান্ন দ্রব্য ক্রয় করে আতœীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল গ্রামীণ সমাজে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সেসব দৃশ্যপট খুব বেশি একটা দেখা যায় না বললেই চলে। বাঙালিয়ানা সংস্কৃতির যে আমেজ পরিলক্ষিত হওয়ার কথা সেটা কিন্তু ক্রমশই কমে যাচ্ছে।

উৎসব তখনই বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করবে যখন সেটা সার্বজনীন হবে, আর সার্বজনীন তখনই হবে যখন সকল পেশা শ্রেণির মানুষ উৎসাহ এবং বিপুল উদ্দীপনায় কোন রকমের ভয় ভীতি ছাড়াই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো সার্বিকভাবে সার্বজনীন হচ্ছে না, এর পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। সকলেই সমস্যা সম্বন্ধে অবগত রয়েছি, কিন্তু সমস্যার সমাধানের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন সে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছি আমরা।

বাঙালির সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানোর কোনই বিকল্প নেই। আর যদি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয় তবেই বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের অনুষ্ঠানগুলো সার্বজনীনতা পাবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলতে বোঝানো হয়; প্রত্যেক পেশা, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ,গোত্র, জাতির মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে একই কাতারে এসে দীর্ঘদিন ধরে রেওয়াজ হয়ে আসা বাঙালির ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জাগরুক রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করা। পারিবারিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিকীকরণের জন্য সমাজকে শিশুর বাসযোগ্য করার জন্য সরকার সহ সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিপথে যাওয়া তরুণদের সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিশেষে বৈশাখের উৎসব সকলের মাঝে আনন্দ আর উদযাপনের সামগ্রিকতা নিয়ে ঐকতানের বার্তা নিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

৪৭ এ দেশ ভাগে হিন্দু মুসলিম আলাদা হবার পর এ অঞ্চলের মানুষ বেশ বিপাকেই পড়েছিলো। তবে সময় মহাঔষধ। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নতুন এক জাতিস্বত্তা। আমি বলি আধুনিক বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার। তাদেরই এক প্রজন্ম আমি বা আমরা। আমাদের সারা বছরই উৎসব লেগে থাকে। সব উৎসব আমাদের ফুর্তিবাজ এক জাতি বানিয়েছে। থাক না একটু অভাব-অনটন, আনন্দ উৎসব চালু থাক। আর এ সব উৎসবের অন্যতম বাংলা বর্ষবরণ। ছোটবেলা থেকেই পহেলা বৈশাখে ধর্ম গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে মেতে উঠতে দেখেছি বৈশাখের প্রথম ভোর থেকে। এটা আমার গৌরবের ইতিহাস। আমি চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করি। আর পরদিন বর্ষবরণ। যতদিন আমরা থাকবো ততদিন সব উৎসব চলবে। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

অসিত রঞ্জন মজুমদার: মিডিয়া কর্মী।

Print Friendly

Related Posts