গোয়ায় কবি ও লেখকদের ১০ম মিলনমেলা

[ ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলের ছোট্ট শহর গোয়ায় গত ২৯ মে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হল। গত দশ বছর ধরে সংগঠনটির এ ধরণের মিলনে মেলা ভারতের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।মূলতঃ একদিনের জন্যই এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এখনো এটি তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছেন। তাঁরা এটি আরো ব্যাপক পর্যায়ে এগিয়ে নিতে চান। এখনো ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তায় এটি প্রতি বছর পালিত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি নেবার ব্যবস্হা করা হচ্ছে। এবার বাংলাদেশ থেকে কবি ও লেখক শামস্ মনোয়ার এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছেন। উপস্থিত সুধিবৃন্দের সামনে এ অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক, গোপাকুমার রাধাকৃষ্ণান একটি বক্তব্য রাখেন। ভারতের বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকায় এ বক্তৃতা প্রকাশ পেয়েছে। গোপাকুমারের এ বক্তব্যে সংগঠনটির পরিচয়, কর্ম্ পদ্ধতি ও ভবিষৎ দিকনির্দেশনা রয়েছে। পাঠকদের জন্য এটি ইংরেজি থেকে বাংলাকরণ করেছেন আতার্তু্ক কামাল পাশা]     

প্রিয় বন্ধুরা, বৃষ্টি হল কেন? মারিয়া হল হয়ে কলভা যাবার পথে ক্যাব ড্রাইভার বলে উঠল,  এ বছর এই প্রথমবারের মতো বৃষ্টি হল অর্থাৎ ২৩তম রাতে রাত ১০টার সময়। হঠাৎ করে এটা কেন এই বৃষ্টি এল যখন আমরা মাদগাঁও ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম. . .?  সম্ভবত এর অনেক কারণ হতে পারে . . . . কিন্তু আমি যেন অনুভব করলাম যখন বহুজাতিক সংস্কৃতির এই ঐতিহাসিক ভূমিতে কবিতা ও সাহিত্যের এক ‘স্বর্গীয় মিশন’ উদযাপনে আমরা উপস্থিত হয়েছি  সে সময় এটি হচ্ছে স্বর্গ থেকে এক ‘স্বাগত বৃষ্টিপাত’ । হাঁ, হৃদয় যেন বলছে এটি হচ্ছে এক মহা আনন্দময় অনুভ‚তি ও রাজকীয় স্বাগত জ্ঞাপন. . . .
দ্যা ট্রিবুলেন্ট টাইমস।

এ আশির্বাদের বারিধারা, গোলাপ গন্ধ ও  মেইলে শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ দেখে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা উপচে পড়ছে। মিলিত হবার মুহূর্ত পর্যন্ত একটার পর একটা সমসাা ও অসুবিধা এসে বাধাগ্রস্ত করছিল। অনেক বন্ধু আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্বেও বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণে ও দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য  গোয়ায় আসতে পারেননি। প্রথম হোয়াটস্ অ্যাপের ছবিতে চমকে ওঠা দুঃসংবাদ এলো আমাদের প্রধান অতিথি সম্মানিত দুশান্ত নিমাভাত মহাশয়ের এখানে আসবার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পুরো পা ভেঙে ব্যান্ডেজে মোড়ানো ছবি। তিনি এখানে এসে আমাদের সাথে মিলিত হতে বেশ আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁর আসার বিষয়টি ছিল সুপরিকল্পিত। এর পরে মিসেস স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের আর একটি মেসেজ এলো। গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে  পড়ায় অভীক স্যারকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে তিনি ছাড়া পাচ্ছেন না। এ সংবাদটি আমাকে কম্পিত করে তোলে,  কারণ নানা বিষয়ে আমি তাঁর ওপর নির্ভর করছিলাম, আমাদের ভেতর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং প্রতিটি বিষয় আমরা শেষ মুহূর্তেও আপডেট করে রাখতাম। তার সুন্দর ছোটগল্পের বই “লাইভ ইন সিয়েস্তা” (Love in Seista) এ মিলন মেলায় মোড়ক উন্মোচনের অপেক্ষায় ছিল। এসব বিভিন্ন কারণে জোয়ারে জাহাজ বেশ টলটলায়মান ছিল এবং একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।

দূরাগত বন্ধুরা দেবদুতের মতো তাঁদের সহযোগিতার হাত আমাদের কাঁধে রেখেছিলেন শীতল এক পাত্র বিয়ারের মতো শান্ত রাখতে এবং তাঁদের হাত আমাদের কাঁধে রেখে যেন বলছিলেন, আমি তোমার সাথে আছি বন্ধু। তাঁদের মধ্যে আমার বাংলাদেশী বন্ধু ও আন্তর্জাতিক অতিথি শামস্ মনোয়ার মিলন মেলার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন এবং আমার ও পরিবারের সদস্যদের বিদায় মুহূর্ত অবধি উপস্থিত থেকেছেন। তিনি যেসব উপহার সামগ্রী আমার জন্য এনেছেন তার জন্য আমি তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

জের্নাইল আনন্দ স্যার, রবি রঙ্গনাথম স্যার ও তাঁর ভাই রাজ বাবু গন্ধাম বেশ সক্রিয় ভাবে কাজের দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসেন এবং স্টেজেরও দায়িত্ব নেন। তাঁদের বহুমুখী অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে পরিবেশটাকে এমন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে আমাদের মনেই হয়নি যে কোথাও কোন ঘাটতি রয়েছে। পায়েল আগরওয়ালের আন্তরিক উদ্যোগ ও সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই যিনি গোয়ার পভোরিম থেকে এসেছেন। এর আগেও তিনি ব্যাঙ্গালোর ও গুজরাটে দু’বার মিলন মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের মাঝে আরো অনেক নতুন কবি ও লেখক এসেছেন এ মিলন মেলায় যোগ দিতে কেরালা, তামিলনাড়, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, নয়া দিল্লী, কলকাতা, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও বাংলাদেশ থেকে।

লেখকবৃন্দ উপস্থাপন করা তাঁদের লেখামালার ওপর বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করছিলেন।

আমি আমার অর্ধাঙ্গিনী সনুর ওপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর, আমার ছেলে মেয়েরা মিলন মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক পর্বে সহযোগিতা করছিল। আমি আমার মেয়ে নিবেদিয়া, নির্মলিয়া ও নিরাময়ার প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি তাদের পরিবেশিত নৃত্য, প্রার্থনা সঙ্গীত ও এ মেলায় অন্যান্য কাজে সহযোগিতার জন্য। আমি মনে করি তারা শুধু আমার সন্তান হিসেবে অংশগ্রহণ করেনি বরং, তাদের মেধা ও সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞা প্রকাশ করে আমাদের আনন্দ দিয়েছে।

বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা সঙ্গীত অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

আমরা এ অনুষ্ঠানে কিছু বইয়ের পরিচিতি ঘটিয়েছি যেগুলো খুব শিগ্রি এ সপ্তাহের ভেতরই অনলাইনে পাওয়া যাবে।

ব্যালাডস অ্যান্ড বার্ডস্ (Ballads and Bards)- সঙ্গীত ও ব্যালাডের সংহিতা।
নক্ষত্র, আকাশ এবং কবিতামালা (Stars, Sky and poesies) শিশুদের জন্য একটি সংকলন, ‘‘Let them recite series’- এর তৃতীয় সংস্করণ।
Love in Seista – অভীক গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পসংগ্রহ।
বাংলাদেশের শামস মনোয়ারের কবিতার বই-পেরিমিটার (Perimeter)।
সমীর কুমার হুই (ড. সমীর কুমার হুই, উড়িষ্যা)-এর দি নিউ বিগিনিং কবিতা সংকলন (The New Beginning) ‍ও
গীতা নাইর জি-এর (অধ্যাপক গীতা নাইর জি) শোর্ড ফ্রাগমেন্টস্ (Shored Fragments)।

এ ছাড়াও অন্য প্রকাশকের দ্বারা প্রকাশিত দু’টি প্রকাশনা Voices of the Void, (ড. জার্নেইল আনন্দ) জার্নেইল এস আনন্দের দ্বারা সংকলিত কবিতা সংকলন এবং মনোজ কৃষ্ণন-এর সংকলিত “The fragrance of nature and love”।

আমার কৃতজ্ঞতা থেকে গেলাম সব কবিদের প্রতি আর তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও প্রতি যাঁদের উপস্থিতি এ মিলন মঠকে একটি পারিবারিক বর্ণচ্ছটায় রাঙিয়ে দিয়েছিল। স্বম্ভবতঃ তাঁদের অনেকেই অনুভব করতে পেরেছেন, কবিতা কি এবং এর মাধ্যমে কি সূত্রপাত হতে পারে। ভারত পুরস্কার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারপ্রাপ্ত সম্মানীয়দের অংশগ্রহণের জন্য তাঁদের জানাই শুভেচ্ছা। তাঁদের উপস্থিতিতে আমরা অত্যন্ত খুশি এবং তাঁদের মেধার প্রতি আমরা সম্মান জানাচ্ছি।

গোপালাকৃষ্ণ পনিক্কার স্মরণে দু’টি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমরা আনন্দের সাথে বলছি যে, ২০১৯ সালের ভারত অ্যাওয়ার্ড (৫০০০ রুপি) স্পন্সর করেছেন ড. সুজাতা গোপাল তাঁর পিতা গোপালাকৃষ্ণ পনিক্কার স্মরণে। গোপালাকৃষ্ণ পনিক্কা সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নির্বাচনী কাজে একজন গেজেটেড অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ও অবদান উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দের কাছ থেকে সম্মান অর্জন করে।

আমার জন্য এটি একটি বিশাল প্রাপ্তি যে তরুণ লেখকরা সাহিত্যকে যথার্থ মূল্যায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। এটি আমাকে শেকড় পর্যন্ত যোগসুত্র রাখতে একটি বোনাস হিসেবে কাজ করবে। এ মিলন মেলা সর্বাঙ্গীনভাবে সফল হোক।

ড. সুজাতা গোপালকে আমাদের এ অনুষ্ঠানে বিপুলভাবে সহায়তা করার জন্য শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ও সে সাথে অতীত দিনে মিলন মেলার সুন্দর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করার জন্য আগেকার স্পনসরদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। টেগোর পুরস্কার ও ভারত পুরস্কারের অর্থায়নে অনলাইনে বিজয়ীদের খুব দ্রুত পুরস্কার প্রদান করা হবে।

চ্যান্টিং বার্ড আবৃত্তি প্রতিযোগিতা সত্যিই অপূর্ব হয়েছে আর আশাতীত-সংখ্যক প্রতিযোগি অংশগ্রহণ করেছেন। শিল্পকলার এ দিকটির অনেক উন্নতি হয়েছে এবং প্রার্থনা সঙ্গীতের সুন্দর এ বিকাশটি তো দেখবার মতো হয়েছে। আমাদের শুভেচ্ছা রইল বিজয়ীদের প্রতি, নয়াদিল্লীর ভৌমিক মালিক, কেরালার জিঞ্জু সুলাইখার প্রতি, অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ বাবু গন্ধমের প্রতি যাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন যথাক্রমে ১০০০/-, ৭৫০/- ও ৫০০/- রুপি লাভ করেছেন প্রতীকী পুরস্কার হিসেবে।

আমরা গ্রান্ড হোটেল লা পাজ, ভাস্কো দা গামা হোটেল কর্তৃপক্ষকে তাঁদের ব্যবস্থাপনা ও পেশাগত দায়িত্বের সুন্দর উপস্থাপনের জন্য, হলঘর সুন্দরভাবে দেবার জন্য। দুপুরের সুন্দর আহারভাবে পরিবেশের জন্য আমরা তাঁদের প্রশংসা করছি।

আমরা সামনের দিনগুলোতে আমাদের আরো বেশি কার্যকর অগ্রযাত্রায় আরো বেশি অংশগ্রহণকারীদের অংশগ্রহণে আশাবাদী এবং মানসিকভাবে, মেধার সাথে ও আত্মিকভাবে আরো সামনে এগিয়ে যাবার আশা করছি।

আপনাদের সমর্থনকে আমি ধন্যবাদ জানাই।

গোপাকুমার রাধাকৃষ্ণান

তথ্যসূত্র : poiesisonline.com

Print Friendly

Related Posts