আসন্ন বাজেট ২০১৯-২০ : প্রত্যাশা ও চাহিদা

মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান

বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের সর্বোচ্চ বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে আগামী ১৩ জুন ২০১৯। রাজস্ব আয়ের সর্বোচ্চ ও সাহসী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৫ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকার কম বেশী বাজেট পেশ করার প্রস্তুতি প্রায় শেষ।

“সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ” শিরোনামে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ নির্বাচনী ইশতিহারে আগামী পাচঁ বছরের (২০১৯-২৩) লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচীর যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, এই বাজেটে তার একটি হাতছানি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট আভ্যন্তরীন উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭.৮৬ হারে এবং আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নির্বাচনী ইশতিহারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশী, যা বর্তমানে (২০১৮) ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পালন হবে ২০২১ সালে এবং এই ২০২১ সালেই বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাড়াঁতে হলে ২০ বছর (২০২১-২০৪১) বাংলাদেশকে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ১০ শতাংশ ধরে রাখতে হবে। সুতরাং বাজেটের আকার বৃদ্ধি হবেই এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতেই হবে।

বাজেটের কাহিনীতে আমরা সবাই শুনে থাকি বাজেট ঘাটতি এবং এই ঘাটতি পূরণে প্রথমেই অস্ত্রোপচার হয় শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতে। আশা করি এবার তা হবে না এবং নির্বাচনী অঙ্গীকারেও শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপারে পরিস্কার ও বিশদ লক্ষ্যমাত্রা ও পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত ব্যক্ত করা হয়েছে। কর্মকৌশল নির্ধারণ করে বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে বরাদ্দ যা লাগার লাগুক না। যেহেতু বাজেট হচ্ছে সরকারী আয় ও ব্যয়ের সংখ্যাগত হিসাব এবং আমাদের সরকার সাধারণত আগে ব্যয় নির্ধারণ করে এবং পরে আয়ের উৎস ঠিক করে; তাই সংশোধিত বাজেটকেই আসলে মূল বাজেট হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

আর যখনই বাজেট সংশোধন হয়, তখনই মানব সম্পদ সম্পর্কিত উন্নয়ন বাজেটে বড় ধরনের কাট-ছাট হয় এবং দেখা দেয় সেক্টর বাজেট ঘাটতি। সাধারণত বিভিন্ন মহল থেকে দাবি বা চাহিদা না থাকলে খাত ভিত্তিক বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ হয় না, আবার এটিও ঠিক যে, আমাদের কাঠামোগত দূর্বলতার কারণে বরাদ্দকৃত (যাই হোক না কেন) বাজেটও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না।

অন্যদিকে গরীবের পক্ষে দাবি তোলার কেউ নেই; তাই দারিদ্র বিমোচনে সরকারকেই নানা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়। এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বেষ্টনির বরাদ্দ এবং নানামূখী দারিদ্রবিমোচন ভিত্তিক কর্মসূচীর বিশাল বাজেট সরকারেরই বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের দায়বদ্ধতার ফলাফল। এবারের বাজেটে পুজিঁবাজারে অর্থায়ন বাড়ানোর জন্য জোর দাবী উঠেছে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নানা দূর্বলতা সত্ত্বেও এই খাতে প্রনোদনা এবং ভূর্তকি দেয়ারও জোর দাবি জানানো হচ্ছে। অথচ নদী ভাঙ্গনের কারণে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে মানবতের জীবন-যাপনে ঢাকায় বসবাসরত ৩৫ শতাংশ মানুষ যারা বস্তিতে বাস করে তাদের জীবন-মান উন্নয়নে প্রনোদনা বা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার দাবির অভাব দেখা যাচ্ছে। সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে খাস পুকর সংরক্ষণ বা পূন:খননের জন্য জোর দাবি দেখা যাচ্ছে না। প্রায় ৬ শতাংশ হারে ঢাকায় মাইগ্রেশন বা স্থানান্তরিত মানুষ বাড়ছে। অন্যান্য শহর বা গ্রামের পরিকল্পনায় নানামূখী উন্নয়ন বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। বাজেটকে করতে হবে জনঅংশগ্রহণমূলক এবং সকলের কাছে বোধগম্য। বাজেটকে সকলে সহজভাবে বুঝতে হবে। পুজিবাজার, ব্যাংকিংখাত, তারল্য সংকট, মূদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি বাজেট বিষয়ক পরিমন্ডলে নানান ব্যবস্থা এবং অবস্থা।

বাজেট হচ্ছে সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের সংখ্যাগত পরিকল্পনা। সরকারের নির্বাচনী ইশতিহারে গ্রামকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করে বিভিন্ন লক্ষ্য ও পরিকল্পনা অঙ্গীকার করা হয়েছে। সুতরাং অভিজ্ঞ সরকারের এই রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের প্রথম বাজেট ২০১৯-২০ অর্থবছরের দিকে আমরা চেয়ে আছি। ন্যায্যতা ভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন হলে আয় বৈষম্য যেমন কমবে, তেমনি উৎপাদনমূখী, কর্মসংস্থানমূখী, দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নমূখী এবং রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনমূখী বাজেট বাস্তবায়নে সকলের অংশগ্রহণে দক্ষ চালকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: গবেষণা পরিচালক, ডরপ
ইমেইল: research@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts