হাসপাতালে সহিংসতা : চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত

ডা. মো. ছায়েদুল হক

আমরা বর্তমানে এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যখন পৃথিবীতে চলছে মুক্ত বাজার অর্থনীতির ঢেউ। সমাজে মানুষের মননে লোভ, দুর্নীতি সহিংসতার  প্রভাব প্রবল; ভোগ বিলাসের প্রতি আসক্তি মৌলিক মূল্যবোধকে প্রায়ই ছাপিয়ে যাচ্ছে যার পরিনতিতে নিজের মুনাফা বা সুযোগ সুবিধা নিশ্চিন্তে    বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার প্রতি ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী সহিংসতার এই ঝুকি কর্মস্থলেও বাড়ছে। কর্মস্থলে যত সহিংসতা হয় তার মধ্যে হাসপাতালে সংগঠিত সহিংসতা অন্যান্য কর্মস্থলের সহিংসতার চেয়ে চার গুণ।

কর্মস্থলের সহিংসতা বলতে বুঝায় কোন ধরণের ধমক ধমকি বা গালিগালাজ বা শারীরিক লাঞ্ছণা বা যৌন হয়রানী যাতে কর্তব্যরত ব্যাক্তি আক্রান্ত হয় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। হাসপাতালে সাধারণত চিকিৎসক, নার্স বা সিকিউরটি গার্ড বা কর্তব্যরত কোন স্টাফ, রোগী বা রোগীর লোকজন কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে থাকে।

হাসপাতালে সহিংসতাকে উস্কে দেয় এমন কারণগুলো অনুধাবন করতে গেলে কয়েকটি বিষয় সামনে আসে । রোগী বা তার লোকজনের বেলায় বিবেচ্য যেমন: রোগীর মানসিক অবস্থা; এলকোহল বা ড্রাগ আসক্ত ভিজিটরের উপস্থিতি; সেবা প্রদানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা; প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দীর্ঘ ব্যবধান; উচ্চমূল্যে সেবা গ্রহণ; মৃত্যুকে মেনে নিতে অপারগতা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উস্কে দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে সেবা প্রদানকারী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেলায় বিবেচ্য যেমন: স্টাফ স্বল্পতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি ফলশ্রুতিতে সেবা কার্যক্রমে প্রত্যাশা পুরণে ব্যার্থতা; রোগীর সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যার্থতা; অতিরিক্ত কাজের চাপে যথাযথ মনোযোগ প্রদানে ব্যর্থতা; দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উস্কে দিয়ে থাকে।

সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধার স্বল্পতা বা রোগীর প্রত্যাশাপূরণে ব্যার্থ হওয়া; সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মূনাফার মনোবৃত্তি সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক নার্স বা অন্যান্যদের অসাধুতা ও সৌজন্যমূলক আচরণ; উচ্চমূল্যে সেবা গ্রহনে রোগীর মধ্যে একধরণের আকাশচুম্বি প্রত্যাশা কাজ করে যা পূরণে ব্যার্থ হলে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে; মিডিয়া, নীতিনির্ধারকদের নেতিবাচক মনোভাব যা সাধারণকে প্রভাবিত করে থাকে; চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে আস্থার সম্পর্কে চিড় ধরায় এমন বিষয় ; চিকিৎসকদের অবহেলা; বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে  এক ধরণের নির্লিপ্ততা; মৃত্যুকে মেনে নিতে রোগী বা তার লোকজনের অনীহা ইত্যাদি বিষয়গুলি শেষ পর্যন্ত কোননা কোনভাবে সহিংসতায় ভূমিকা রাখে।

পৃথিবীতে অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও চিকিৎসা সেবার অতি বানিজ্যিকীকরণের কারণে এবং একই সাথে উচ্চমূল্যে সেবা গ্রহণকালে নিজ পকেট থেকে উচ্চ হারে খরচ সংকুলান করতে যেয়ে রোগীর সাথে চিকিৎসকের  আস্থার সম্পর্কটি নিম্নমূখী হওয়ায় চিকিৎসা সেবা নিয়ে সমাজে এক ধরণের অসন্তুষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। যার ফলে হাসপাতালে সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে এবং এই নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের বিশেষ করে চিকিৎসা প্রশাসন, নীতি নির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোপরী গনমাধ্যমের ভূমিকা অনেক সময় আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে। ফলে চিকিৎসা সেবার কার্যক্রমটি এক ধরণের ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়।

হাসপাতালে সহিংসতার বিষয়টি বেশীর ভাগ সময় নিভৃতে থেকে যায় ; আবার অনেক সময় গোচরীভূত হলেও পরে ধামাচাপা পড়ে যায়।  খুব অল্প সংখ্যক ঘটনা সমাজে আলোচিত হয়। শেষ পর্যন্ত  যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা খুবই কম। বেশীরভাগ সহিংসতার ঘটনা  হুমকি-ধামকি ; ভীতি প্রদর্শন বা গালিগালাজ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিষয়টি অনিষ্পত্তি অবস্থায় থেকে যায় এবং এটি নিয়ে হাসপাতাল/প্রশাসন/চিকিৎসক/রোগীর লোকজন কোন সিদ্ধান্তে পৌছানোর চেষ্টা করেন না। ফলে দেখা যায় এরূপ ঘটনা সবার গা সহ্য হয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষৎে অধিকতর ভয়ংকর ঘটনা ঘটার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখছে ফলশ্রুতিতে  শারীরিক লাঞ্ছণা ও ভাংচুরের মত ভয়ংকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

হাসপাতালে সহিংসতায় সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়ে থাকে নার্স এবং চিকিৎসক। কারণ তাদেরকে রোগীর সাথে অধিকতর সময় কাটাতে হয়। বিশেষ করে যাদের এসব জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা কম বা অতিরিক্ত কাজের চাপে ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটে  অথবা কম জনবলদিয়ে অধিকতর রোগীর চিকিৎসা প্রদান করতে যেয়ে রোগীর বা তার লোকজনের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে ব্যার্থ হয় অথবা সঠিক রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে ব্যার্থ হয় তারা অধিকতর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

এসব সহিংসতায় অনেকেই যার যার অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন।  বিশেষ করে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয় হতে পারে সেটি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল অভিজ্ঞতা বা চিকিৎসা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রীতা বা চিকিৎসকের যথাযথ মনোযোগ ও সময় না পাওয়া, তারা সাধারণত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান। বর্তমানে জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং আধুনিক চিকিৎসা সম্বলিত হাসপাতালের স্বল্পতাহেতু সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করছে এবং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় এরা সরব ভূমিকা পালন করে থাকেন। অনেকেই মনে মনে খুশী হন। তবে এর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব কি হতে পারে সে বিষয়ে অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে চান না। তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসক,নার্স ক্ষতিগ্রস্থ হলেও দীর্ঘমেয়াদে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হবে সমাজ ও সামগ্রীক চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাৎক্ষনিকভাবে সহিংসতার ফলে  চিকিৎসক যখন অনিশ্চিয়তায় ভোগেন তখন জটিল রোগীর চিকিৎসা কার্যক্রমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এই সমস্ত রোগীকে (চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হলেও ভয়ে) উচ্চতর সুযোগ সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালে বা বিদেশে রেফার করে দিতে সচেস্ট হন, বিশেষ করে রোগী বা রোগীর লোকজন যদি প্রভাব প্রতিপত্তিশালী হন অর্থাৎ জটিল রোগের চিকিৎসায় এক ধরণের শৈথিল্যভাব পরিলক্ষিত  হয়। রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকগন অধিকতর ইনভেস্টিগেশন বা পরীক্ষা নীরিক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে  ঝুঁকি এড়াতে অপ্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেসন বেড়ে যাবে এবং চিকিৎসা খরচ আরও বেড়ে যাবে।

তৃতীয় আর একটি উপসর্গ দেখা দেবে, সহিংসতা পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকগণকে এক ধরণের স্ট্রেস, ভয়, দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং তার মনে এক ধরণের অনিশ্চিয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। ফলে একজন চিকিৎসক তার ছেলে মেয়েকে চিকিৎসা পেশায় আসতে উৎসাহ প্রদান থেকে বিরত থাকবেন।

চীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০০২ সালে সেখানে ১১% চিকিৎসক বাবা মা তাদের সন্তানকে চিকিৎসা পেশায় আসতে দিতে চাইতেন  কিন্তু  ২০১১ সালে কেবল ৭% বাবা মা সন্তানকে একই চিকিৎসা পেশায় আসতে দিতে চান।

মেধাবী চিকিৎসকদের সন্তানেরা একই পেশায় না আসলে এবং ইমেজ সংকটের কারণে অন্যান্য মেধাবী ছেলে মেয়েরাও এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে পুরো চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে এক ধরণের মেধার ঘাটতি দেখা দেবে। বর্তমানে মেধাবী ছেলেমেয়ারা কম ঝুঁকিপূর্ণ ও অধিকতর আরাম আয়েশ নিশ্চিত হয় এমন পেশার দিকে ঝুঁকে পড়বে যার নমুনা ইদানীং কিছুটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের এক বিরাট অংশ এখন নন মেডিকেল প্রফেশন বেছে নিচ্ছে এবং দেশের বাহিরে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার জন্যে চলে যাচ্ছে।

চিকিৎসা সেবার স্বার্থেই হাসপাতালে সহিংসতা বন্ধ করা ও নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধ হওয়া খুবই জরুরী। এই কাজটি করতে হবে একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে-যেখানে চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমসহ সকলেই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসককে আরো সহনশীল ; দায়িত্বপূর্ণ ও অতিবানিজ্যিক মনোভাব ও অসুদোপায় অবলম্বন পরিহার করে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমে নিবেদিত হতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ সুযোগসুবিধা ও প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি সন্নিবেশিত করে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই হাসপাতালে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নীতি নির্ধারকদের দায়িত্বশীল হতে হবে যাতে নেতিবাচক প্রচারণা নিরুৎসাহিত হয়। এই ব্যাপারে মিডিয়ার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সর্বোপরী যেখানেই চিকিৎসা কার্যক্রমে অবহেলা ও সহিংসতা দেখা দিবে সেখানেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে গুটিকয় চিকিৎসক বা নার্সের অবহেলা বা অপকর্মের জন্য ; কোন কোন বিচ্ছিন্ন রোগী বা তার লোকজনের সহিংস আচরণের জন্য;  অতি মুনাফালোভী কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য বা কারো কারো নেতিবাচক প্রচারণার জন্য সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এক ধরণের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সঠিক জায়গায় রাখতে আমাদেরকেই দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

ডা. মো. ছায়েদুল হক: চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক।

sayedul.hq@gmail.com

Print Friendly

Related Posts