স্মরণ : শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার

রিপন শান: সারেঙ বৌ ছবির সেই কালজয়ী গান- ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া- এই গানের তরঙ্গায়িত সুকুমার কন্ঠ আর দিলদরিয়া আবেগের সাথে গানপিয়াসী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে  চির জাগরুক মানুষটির কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার ।

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে তাঁর গাওয়া ‘জয় বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে’, ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে’ ইত্যাদি গানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি হয়ে রয়েছেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর আন্তরিকতা নিয়ে গাওয়া গান মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে ফোটাতো হাসি, চোখে জন্ম দিতো হেরে না যাওয়া আশা আর বুকে এনে দিতো স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার শক্তি।
তাঁর গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালে মার্চ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।
১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক ও ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ২০০০ সালে বাচসাস পুরস্কার, ২০০৩ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস – আজীবন সম্মাননা, ২০১১ সালে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
আব্দুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী গীতিকার শাহীন জব্বার যার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, ফাতেমা তুজ জোহরার মত জনপ্রিয় বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পীরা। তাদের সন্তান মিথুন জব্বারও একজন সঙ্গীতশিল্পী। জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা যিনি ২০১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার আগ অবধি সঙ্গীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মেলেনি আব্দুল জব্বারের। পরীক্ষায় পাশ করার পর ওস্তাদ ওসমান গণি ও ওস্তাদ লুৎফর হকের কাছে সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন তিনি। আব্দুল জব্বারের বিশ্বাস ছিল, কারো কণ্ঠে যদি সুর থাকে তবে একদিন না একদিন গান গেয়ে সে নাম করবেই। গলায় থাকা সুর তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে জনপ্রিয়তার শিখরে।
জব্বার ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র সংগমের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে এতটুকু আশা ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া “তুমি কি দেখেছ কভু” গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। একই বছর ঢেউয়ের পর ঢেউ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে “সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো” গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৭০ সালে রবীন ঘোষের সুরে তিনি পীচ ঢালা পথ ছবিতে “পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি” এবং ১৯৭১ সালে নাচের পুতুল ছবির শিরোনাম গান “নাচের পুতুল”-এ কণ্ঠ দেন। ১৯৭৮ সালে সারেং বৌ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে “ও..রে নীল দরিয়া” গানটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়।
ভরাট কণ্ঠের যাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখা এ শিল্পীর দীর্ঘ ৫০ বছরের সঙ্গীতজীবনে ২০১৭ সালে প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ মুক্তি পায়। অ্যালবামটির গীতিকার মোঃ আমিরুল ইসলাম, সুরকার গোলাম সারোয়ার। একই বছরে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গানের অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। গীতিকার আমিরুল ইসলাম রচিত ” বঙ্গবন্ধু দেখেছি তোমায় দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ ” শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দেয়ার আগেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যালবামের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা যুগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অংসখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গাওয়ার মাধ্যমে তিনি ১২ লাখ রুপি উপার্জন করেন, এই টাকা তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে না রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন। ভারতে তাঁর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ১৯৭১ সালে মুম্বাইয়ে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরিতেও কাজ করে যান আব্দুল জব্বার।
শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী  আব্দুল জব্বার ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগনিত ভক্ত সুহৃদ স্বজন সুজনকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অনন্তলোকে পাড়ি জমান ।
Print Friendly

Related Posts