প্রবীণ জনগোষ্ঠীর রাজাপুর এখন আশাপুর

এএইচএম নোমানমো: হারুন অর রশিদ

 

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন কর্মসূচী পিকেএসএফ এর আর্থিক সহায়তায় একটি সেবামূলক ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম। যা সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে বেসরকারি সংস্থা র্ডপ এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। শিশু থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পিকেএসএফ এর অন্যান্য কর্মসূচীর পাশাপাশি এই নতুন কর্মধারা রাজাপুর ইউনিয়নের সকল মানুষের মাঝে আশার আলোক বার্তা বহন করে এনেছে।

ইতোমধ্যে রাজাপুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের সকল প্রবীনের ভোটার আইডি অনুযায়ী ১৯৪০ জন প্রবীণ জরিপের আওতায় এসেছে। তথ্যগুলি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যার মধ্যে পুরুষ ১০১৭ জন এবং মহিলা ৯২৩ জন। আশাপুর ইউনিয়নের পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ চর এলাকা। যমুনার শাখা নদীর পাড় ঘেসে ১৩টি গ্রাম। তার মধ্যে ০৫টি গ্রাম একেবারে যমুনা নদীর পাড়ে। গ্রামগুলি খন্ড খন্ডভাবে বিস্তৃত। এখানকার আর্থ-ভৌগলিক অবস্থা একেবারে খারাপ। অনেকের বসত বাড়ী পর্যন্ত নাই। অন্যের জমিতে থাকে, অনেকের তিন বেলা খাবার যোগাড় করতে কষ্ট হয়। দুঃখ কষ্টে থাকা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সেবার নিমিত্তে প্রবীণের মাঝে বয়স্ক ভাতা, শারীরিকভাবে নাজুক ও বঞ্চিত শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ, ছাতা, চাদর, বয়ষ্কদের জন্য ওয়াকিং ষ্টিক, হুইল চেয়ার, ওয়াশ রুমের জন্য কমোড, স্বাস্থ্য সেবা, মৃতদের জন্য সৎকারের ব্যবস্থা ও ঋণ সুবিধা চালু করা, অস্বচ্ছল প্রবীণকে ভরন পোষন ও আবাসনের ব্যবস্থা, সিনিয়র সিটিজেন সম্মাননা, প্রবীণ সম্মাননা ও এককালীন আর্থিক সুবিধা, শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্মাননা পুরুস্কার, প্রবীণ সামাজিক কেন্দ্র ঘর তৈরি, প্রবীণ নেতৃবৃন্দের ওরিয়েন্টেশন প্রদান ইত্যাদি করা হয়। দেখা যায়, যে সকল প্রবীণ কষ্ট স্বীকার করে ছেলে মেয়েদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এবং যাদের কর্মসংস্থান হয়েছে, তারা এখন অভিভাবকদের প্রতি যত্নশীল এবং সর্বদাই মা-বাবার খোঁজ খবর নিচ্ছেন ও পরিচর্যা করছেন।

দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় রাজাপুর ইউনিয়নের, সমেশপুর গ্রামের মোছা: তামসি বেগম (৭৭) এর কথা। তামসি বেগম বলেন ‘স্যার কি বলবো আপনাদের এই কর্মসুচি সর্ম্পকে, এই কাজের কোন তুলনা হয়না। বিশ্বাস করেন স্যার আজ পর্যন্ত আমার বাড়ীতে এমনি করে খোজ খবর নেওয়ার বা বয়স্ক ভাতা দেওয়ার জন্য কেউ আসে নাই। স্যার আমি যে বয়স্ক ভাতা পাই তা দিয়া আমার সংসারে কি উপকার হয় তা আমি আপনাদের বুঝাতে পারবো না। আপনারা তো লাভ খোঁজেন না, বুদ্ধি পরামর্শের সাথে বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে থাকেন, ইহার কোন খারাপ কিছু নাই। সবই ভাল।’ তামসি বেগম দুঃখ করে বলেন, ‘স্যার আমার ২ ছেলে ১ মেয়ে ওদের লেখাপড়া শিখাতে পারি নাই। ছেলে ২টা দিন মজুরীর কাজ করে। ওদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। আমাদের খোজ নিতে পারে না। এই বৃদ্ধ বয়সে কিভাবে চলবো, এই সময় আপনাদের পরামর্শ এবং এই সাহায্য টুকু আমার অনেক উপকার হয়েছে। এই কাজের সাথে যারা আমাদের নিয়ে চিন্তা এবং সাহায্য করতেছে আমি তাদের সকলের জন্য দোয়া করি, তারা যেন সুস্থ ও ভাল থেকে আমাদের জন্য কাজ করতে পারে।’

প্রকল্পে গ্রাম কমিটি, ওয়ার্ড কমিটি, ইউনিয়ন প্রবীণ কমিটি গঠিত ও মিটিং হয় যেখানে ক. সকল প্রবীণদের খোঁজ খবর নেওয়া। খ. প্রবীনের সাথে খারাপ আচরণ না করে সে দিকে লক্ষ্য রাখা। গ. অসুস্থ্য প্রবীণকে দেখা শুনা করা। ঘ. স্বাস্থ্য কার্ড ব্যবহার। ঙ. নিরাপদ খাবার পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়:নিষ্কাশন ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি। চ. প্রবীনের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে সঞ্চয় গঠন। ছ. বিভিন্ন দিবস পালন। জ. আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ। ঝ. আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। ঞ. সকলে সকলের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি।

ক্ষুদ্র ঋণের রোপিত বীজ থেকে মানব কেন্দ্রীক সামগ্রীক উন্নয়ন লতাপাতা সৃষ্টি হয়ে যে বৃক্ষ সৃষ্টি হচ্ছে তার পতাকাবাহী অর্থনীতিবীদ ‘সমৃদ্ধি বন্ধু ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ’র সাহসী ও সেল্পলেস চিন্তাধারারই এর সফল ফসল। ২০১৪ সাল থেকে বটম আপ প্রক্রিয়ায় দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ‘সমৃদ্ধি’ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মানব কেন্দ্রিক সমৃদ্ধি কর্মসূচী দারিদ্র বিমোচন, পিছিয়ে ফেলাদের সম্পদ ও সামর্থ অর্জন সমৃদ্ধির মূল লক্ষ্য। দরিদ্র থেকে বের হয়ে সামাজিক মর্যাদায় এসে নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রয়াসের অপর নাম ‘সমৃদ্ধি’।

পিকেএসএফ গাইডে ও সমৃদ্ধি কর্মসূচী বাস্তবায়ন লক্ষ্যে যে সকল কাজ হয়ে থাকেঃ ১. স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি ২. শিক্ষা সহায়তা ৩. পরিবার উন্নয়ন পরিকল্পনা ৪. আর্থিক সহায়তা ৫. বিশেষ সঞ্চয় ৬. আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ ৭. যুব উন্নয়ন (যুব প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান) ৮. শতভাগ স্যানিটেশন ও হাত ধোঁয়া ৯. বসত বাড়িতে সবজি চাষ ১০. ভিক্ষুক পুনর্বাসন ১১. স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমমানে উন্নয়ন ১২. সমৃদ্ধি ওয়ার্ড সমন্বয় কমিটি গঠন ও সমৃদ্ধিকেন্দ্র স্থাপন কাজ এগিয়ে চলছে।

প্রবীণ আবুল কাশেম (৬৩) প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘জীবনে অনেক কর্মসুচি দেখেছি কিন্তু প্রবীনদের নিয়ে এমন কর্মসুচি আমার জীবনে এই প্রথম। আমি মনে করি এখনও অনেক ভাল মানুষ আছে। তা না হলে আমাদের মত বৃদ্ধদের নিয়ে এমন সুন্দর কাজ কেউ করে না। আপনারা আমাদের ছেলে মেয়েদের পরামর্শ দিয়ে সচেতন করে তুলছেন। আমাদের বয়স্ক ভাতা দিতেছেন, শীত বস্ত্র দিচ্ছেন, আগামীতে আরো বেশি বেশি প্রবীনদের পাশে দাড়াবেন এই আশা এবং দোয়া করি।’ তিনি আরো বলেন, তাকে ১০ বৎসর বয়সে বিবাহ দেন তার বাবা, যাকে বাল্য বিবাহ বলে, তখন তার স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বৎসর। বর্তমানে তার ২ ছেলে ৫ মেয়ে। সব মেয়েদের বিবাহ দিয়েছেন। বড় ছেলে বিবাহ করে আলাদা থাকে। আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘আমার ছোট ছেলের মাথায় সমস্যা (পাগল), সংসারের অবস্থা ভীষন খারাপ, এই বয়সে আমাকে অনেক কাজ করতে হয়। তা না হলে যে সংসার চলে না। এই সময় প্রবীন কর্মসুচীর আওতায় বয়স্ক ভাতা পেয়ে আমি অনেক খুশি।’

অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে তার পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আরও অধিক বিনিয়োগ সমতা প্রয়োজন তাহলেই মানবিক ও অর্থ-বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরা যাবে। গ্রামীণ পর্যায়ে সমন্বিত দারিদ্র্র্য বিমোচনে ‘প্রচুর কাজ-খাত’, ‘প্রচুর বিনিয়োগ’ দরকার। ‘নীচ থেকে উপরে এবং উপর থেকে নীচে’ সরকার পরিকল্পনায়, সমর্থনে ও স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন জন নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্ততায় এ এক উজ্জ্বল দারিদ্র বিমোচন দৃষ্টান্ত। এক প্রজন্ম মেয়াদী ও টেকসইতার লক্ষ্যে বটম লাইনিং মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ বাস্তবায়ন, তা-ও ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদই পারে এর বন্ধন ঘটাতে।

অতএব পিকেএসএফই একমাত্র আস্থার ভান্ডার, যার মাধ্যমে অধিক বিনিয়োগসহ সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব।

এএইচএম নোমান: গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী,

মো: হারুন অর রশিদ: প্রোগ্রাম অফিসার, ডরপ ।

ই-মেইল-nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts