ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধসমূহ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

এ্যাডভোকেট মোঃ কাওসার হোসাইন

মানুষের জীবনে প্রযুক্তিগত কল্যান নিশ্চিতের জন্য সর্বত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবা পৌঁছে গেছে। এর সুবাদে ফেসবুক, ইউটিউব, ইমো, ভাইবার, ওয়েবসাইটসহ নানাবিধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুনে।

এজাতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সঠিক ব্যবহার মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ যেভাবে সহজতর করেছে তেমনি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এর অপব্যবহার বা স্বার্থান্বেষী ব্যবহার সৃষ্টি করে নানা সমস্যা এবং তা অন্যর জন্য মানহানিকর, অপমানজনক এমনকি বিরোধ, বিদ্বেষ বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সময়ের পরিবর্তনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে তা প্রতিরোধ করার জন্য সরকার আইন পাশ করতে বাধ্য হয়েছে।তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এজাতীয় আইনের উদাহরন।

বর্তমানে এ সংক্রান্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন,২০১৮ বিদ্যমান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সচরাচর সংঘটিত অপরাধসমূহ হলো ২৫/২৯ ধারার অপরাধ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় উলে­খ আছে যে,কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা জ্ঞাতস্বরে কোন ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল মাধ্যমে কাউকে অপমান,অপদস্ত,বিরক্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বা জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে মিথ্যা কোন তথ্য প্রেরন করে বা প্রকাশ করে বা প্রসার ঘটায় তাহলে তা অপরাধ এবং এজাতীয় অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদন্ড বা ৩লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ড,পাশাপাশি এজাতীয় অপরাধ একাধিকবার করলে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড বা ১০লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ড।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা বিশ্লেষনে দেখা যায় যে উলে­খিত ধারার অপরাধ সংঘটিত হবার জন্য প্রেরিত বা প্রকাশিত বা প্রসারিত তথ্যটি ওয়েবসাইট বা যেকোন ডিজিটাল মাধ্যমে প্রেরিত বা প্রকাশিত হতে হবে যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা জ্ঞাতস্বরে করা এবং তথ্যটি অবশ্যই মিথ্যা হতে হবে,যা অনেকেই বিবেচনা না করে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করতে যান বিধায় অনেক মামলার পিটিশন খারিজ হয়ে যায় বা স্বাক্ষ্য প্রমানে তা প্রমান করতে পারে না বিধায় আসামী বা অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যায়।

এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় উল্লেখ্ আছে কেউ যদি কোন ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে অন্য কারো বিরুদ্ধে মানহানিকর কোন তথ্য প্রেরন বা প্রকাশ করে তাহলে তা অপরাধ এবং উক্ত অপরাধের শাস্তি হলো সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড এবং একই অপরাধ একাধিকবার করলে তার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১০লক্ষ টাকা বা উভয়দন্ড।

উক্ত ধারার মামলা বিশ্লেষন করলে দেখা যায় অপরাধটি কোন ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে হতে হবে এবং প্রেরিত বা প্রকাশিত তথ্যটি বাংলাদেশের দন্ডবিধি-১৮৬০ আইনের ৪৯৯ধারায় সংজ্ঞায়িত মানহানির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।সেক্ষেত্রে দন্ডবিধিতে উলে­খিত মানহানির ব্যতিক্রম ব্যাখাগুলোও প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ দন্ডবিধির ৪৯৯ধারায় যেসকল ব্যতিক্রম ক্ষেত্রগুলোতে মানহানির অপরাধ সংঘটিত হবে না সেসকল ক্ষেত্রেগুলোতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার অপরাধও সংঘটিত হবে না। উল্লেখিত ধারার মামলা দায়ের বা স্বাক্ষ্য প্রমানের মাধ্যমে আসামীর দোষ প্রমানের ক্ষেত্রে বা আসামীকে নির্দোষ প্রমানের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকে সতর্কতার সহিত বিবেচনায় নিতে হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/২৯ ধারার উপাদান অনেকটা একইরকম এবং অনেকক্ষেত্রে দুটো ধারার অপরাধ একত্রে সংঘটিত হতে পারে। ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ কারো বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা জ্ঞাতস্বরে কোন মিথ্যা তথ্য কাউকে অপমান, অপদস্থ, বিরক্ত, হেয় প্রতিপন্ন এবং মানহানি করার উদ্দেশ্যে করে থাকলে বা জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করে থাকলে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১)/২৯(১) ধারার অপরাধ হবে।

উপরোক্ত আইনগত বিশ্লেষনের পাশাপাশি একটি বিষয় আমাদের সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে যে মানুষ সামাজিক জীব এবং একজন সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, যে দায়বদ্ধতার কথা গভীরভাবে চিন্তা করলে এ জাতীয় অপরাধে কেউ জড়িত হতে পারেনা। সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের উচিত আধুনিক প্রযুক্তির ফলে সহজলভ্য হওয়া ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমগুলো সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো, সমাজ ও জনগনের কল্যানের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যানে ব্যবহার করা। অন্য কাউকে অপমান, অপদস্থ, বিরক্ত, হেয় প্রতিপন্ন, মানহানি ঘটানো বা জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন বা গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা নয়। তাহলে একসময় ডিজিটাল অপরাধমুক্ত হবে রাষ্ট্র এবং উপকৃত হবো আমরা সবাই।

লেখক: সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রনেতা।

Print Friendly

Related Posts