মেঠোপথের এক ‘আলোক বর্তিকা’

আরিফ চৌধুরী শুভ

সাদা পাঞ্জাবী আর পাজামা পরে খা খা রোদের মধ্যে খেতের আইল ভেঙ্গে মিতৃকা রঙ্গের সুঠামদেহের একজন দুপেয় মানব সন্তান এগিয়ে আসছেন দূর থেকে। যতদূরই হোক না কেন, দেখলেই চেনা যায় তাকে। বুকের মধ্যে বইখাতা জড়িয়ে রাস্তার পাশে তালতলায় দাঁড়িয়ে সেই মানবের জন্য অপেক্ষা করতো একজন শিশু।কাছাকাছি এলে একই ছাতার নিচে দুজনের পদযুগল একত্রিত হয়ে গন্তব্যের দিকে যাত্রা করতো কথার সমুদ্রে ডুব দিয়ে। সেই পথ যদি না শেষ হতো…।

সময়টা ১৯৯৫ সালের দিকে। সেদিনের সেই দুপেয় মানুষটি ছিলেন আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ উদ্দিন, আর সেই শিশুটি ছিলাম আমি নিজেই। এখন স্মৃতির ফ্রেমে বন্ধি সেই শৈশব। মনে হচ্ছে এখনো স্যারের সাথে প্রত্যাহ হেঁটে যাচ্ছি বিদ্যালয়ে। অথচ আমার গ্র্যাজুয়েশানই শেষ হয়েছে আজ থেকে আরো পাঁচ বছর আগে। সেই স্মৃতি কল্পনায় আসে অনুকম্প নিয়ে,দিয়ে যায় নোনাজল।

৫ অক্টোবর ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা দিবসও। এই সম্মাননা একজন শিক্ষকের সকল প্রাপ্তি কি হতে পারে? তবুও সেরা শিক্ষকদের সম্মাননা পাওয়া তাঁর অধিকার। পদক বাণিজ্যের যুগে এই সম্মাননা যেন সেরা শিক্ষকরাই পান, সেই নিশ্চয়তা এবং দায়ভার রাষ্ট্রের। তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্বটাও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ঠার সাথে করা উচিত। শিক্ষক দিবসে স্মরণ করছি সেই সব শিক্ষকদের, যারা শিক্ষক হতে পেরেছেন শিক্ষার্থীদের কাছে। নিজের অর্জিত শিক্ষাদানের মাধ্যমে একটা নতুন জীবন দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের। যারা বুঝিয়েছেন ভালো আর মন্দের পার্থক্য। যারা বুঝিয়েছেন অর্থই জীবনের সব নয় বরং সম্মানই জীবনের শান্তি।

আরো বুঝিয়েছেন, জীবনে যেকোন পরিস্থিতিতে কোন অন্যায়ের সাথে আপোস নয়,বরং বীরের মতো লড়াই করাই জীবনের প্রকৃত অর্থ। ছাত্রজীবনে এমন অনেক আদর্শের সমুদ্রে যারা আমাকে ডুবিয়েছেন, আমি তাঁদের নিকট চিরকৃতজ্ঞ। যাঁরা আমাকে ভুত থেকে পুত বানানোর মন্ত্র পড়িয়েছেন, তারাই আমার সমস্ত সংগ্রাম আর বিজয়ের প্রতীক। তাদের কাছেই শিখেছি জীবনের আরেক নাম সংগ্রাম, জীবনের আরেক নাম আন্দোলন। আজ  আন্দোলনই আমার জীবন। আন্দোলনই আমার নাম।

আজ  সবচেয়ে বেশি স্মরণ করছি সেই শিক্ষককে, যিনি তাঁর পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন মেঠোপথে শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য। কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়, কিংবা কোন পদকের জন্যও নয়। নদীর চরে জেগে ওঠা একটা অক্ষরজ্ঞানহীন সমাজকে পরিবর্তনের যে গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন, সেই দায়িত্ব সকল কিছু ছাপিয়ে তাকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সব মহলে পরিচিত করেছে। আনন্দদায়ক শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেছেন শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক। তাঁর চেষ্টায় লক্ষ্মীপুর জেলার ১৮ নং কৃশাখালী ইউনিয়নের ফরাশগঞ্জ গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে আজ শিক্ষার আলো জ্বলেছে ঠিকই, কিন্তু নিভেছে তাঁর জীবন প্রদীপ। দেশজুড়ে থাকা অনন্য প্রিয় শিক্ষকদের সাথে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি মাস্টার শহীদ উদ্দিনকে।

চার কক্ষের ছোট স্কুল আমাদের। হাতেগোনা কয়েকটা বেঞ্চে বসতো পঞ্চমের শিক্ষার্থীরা। বাঁশের বেড়ার মাঝখান দিয়ে দেখা যেত পাশের শ্রেণিকক্ষ। জংধরা ফুটো ফুটো টিনের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো তির্যকভাবে পড়তো মাথার উপর। একটু বৃষ্টি আসলেই ক্লাস থেমে যেত।যেদিন মেঘ করতো সেদিন খুব দ্রুত স্কুল ছুটি দিতেন শিক্ষকরা। কালোমেঘ আর দক্ষিণা ঘুর্ণিবাতাস ছুটার আগেই যেন আমরা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারি সেজন্য এই ছুটি দেয়া হতো। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখনো দাড়িপাতার বিচানায় বসে পড়তে হতো। ব্লাকবোর্ড ছিল না বলে স্যাররা ক্লাসে লিখতেন না। কিন্তু লিখতেন শুধু শহীদ স্যার। তিনি লিখতেন স্কুলের কাঠের দরজার পিছনে। খড়িমাটি না থাকলে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে খড়িমাটির বক্স কিনে আনতেন শিক্ষার্থীদের দিয়ে। অংক আর ইংরেজির শিক্ষক ছিল না, তাই পড়ানো হতো বাংলা, সমাজ, বিজ্ঞান এবং ধর্মের বিষয়গুলো।

১৯৯৪ সালে শহীদ স্যার ফরাশগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসার পর একমাত্র তিনিই অংক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান, বাংলাসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও পড়াতেন। বাংলাতে লিখে যে অংক করতে হয়,তা শিক্ষার্থীরা প্রথম শহীদ স্যারের কাছেই শিখেছে। তার আগে কেবল অংক মানে আমরা জানতাম যোগ বিয়োগ গুন ভাগ ছাড়া আর কিছু নাই।

এভাবে কয়েকমাস যাবার পর শহীদ স্যার ফরাশগঞ্জ বাজারের কাঠমেস্ত্রি আবুকে ১০ টাকা দিয়ে একটি কাঠের বোর্ড বানিয়ে ছিলেন। সেই বোর্ড বানাতে ২ টাকার লোহার পেরেক বিনে পয়সায় দিয়েছেন দোকানদার কবির উদ্নি সরকার। এখনো তিনি গর্ব করে সেইসব কথা বলেন। তারপর আমরা পরিচিত হলাম কালো বোর্ডের সাথে। আমার রোল পরিবর্তন হলো কালোবোর্ডের লেখাপড়ায়। ৭৮ রোল নাম্বার থেকে ক্লাস থ্রিতে আমি প্রথম হলাম। জীবনে প্রথম হওয়ার রেকর্ড শুরু সেই থেকেই। আমার প্রতি স্যারের বিশেষ দৃষ্টি পড়লো। সব সময় খেয়াল রাখতেন আমার পড়াশুনার প্রতি। বার্ষিক পরীক্ষা যেদিন শেষ হতো, সেদিন স্যার আমার হাতে পরের ক্লাসের একসেট বই তুলে দিতেন বন্ধের সময় বাড়িতে পড়ার জন্য। নতুন বই আসলে সেই বইসেট জমা দিয়ে নতুন বই নিতাম সবার সাথে। এভাবে আমি এগিয়ে যেতাম।

আমাদের স্কুলটি লাস্ট গ্রেডের স্কুল ছিল। বৃত্তি নামক শব্দটার সাথে আমরা কোনদিনই পরিচিত ছিলাম না স্যার আসার আগে। বৃত্তির জন্য ফরমপূরণ এবং বিশেষ পড়ার ব্যবস্থা এবং জেলাশহরে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়া, পথঘাট চেনা এসব শহীদ স্যারই করেছেন। বিকাল ৪টায় স্কুল ছুটির পর আরো দেড়ঘন্টা বাড়তি পড়াতেন পঞ্চমে বৃত্তির জন্য নির্বাচিতদেরকে। কোন টাকা নিতেন না। স্যারের সারাদিন কাটতো চা কলা আর বিস্কুট খেয়ে। স্যারের দুপুরের খাবারের এমন করুণ অবস্থার কথা মা আমার মুখে শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তখন। আমি ও আমার ছোটবোন যতদিন স্কুলে ছিলাম, মা ততদিন দুপুরবেলায় ডাল ভাত রান্না করে স্যারের জন্য পাঠাতেন। স্যার লেইজারের ২০ মিনিট আগে আমাকে ছেড়ে দিতেন আর আমি বাড়িতে গিয়ে স্যারের জন্য লাঞ্চ নিয়ে আসতাম। আমরা দুই ভাইবোনই পর্যায়ক্রমে সেই স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়েছি শুধু স্যারের জন্য।

২০০১ সালে আমি বৃত্তিপরীক্ষায় পুরো কুমল্লিা অঞ্চলে প্রথম হই। আমার ফলাফলের কথা শুনে স্যার সেদিন কান্না করে দিয়েছিলেন। আমাকে কোলে তুলে আনন্দ করেছিলেন। স্যারের পরিশ্রম সার্থক হলো। চারদিকে স্কুলের সুনাম ছড়ালো। পুরো ইউনিয়নে অন্যান্য বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল। স্যার আরো পরিশ্রমী হয়ে ওঠলেন। শুধু পড়াশুনার মানেই ভালো হয়নি, তারপর থেকেই নিয়মিত বৃত্তি পেতে থাকে লাস্ট গ্রেডের সেই স্কুলটি। তাঁর হাতেই প্রায় অর্ধশতাধিক বৃত্তি এসেছে ফরাশগঞ্জ স্কুলে। লাস্ট গ্রেড থেকে এ গ্রেডের স্কুলে পরিণত হল ফরাশগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। এ সবই তাঁর অবদান।

সারাদিন খেয়ে না খেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে গিয়ে কখন যে জটিল রোগ বাঁধালেন লিভারে সেটি টেরই পাননি। ২০০৯ সালে প্রথম ধরা পড়ে তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই রোগ তাঁর লিভারের প্রায় ৭০ শতাংশকে অকার্যকর করে দেয়। তারপরও তিনি স্কুল ছাড়েননি। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যে শিক্ষক নিয়মিত স্কুলে যেতেন শিক্ষার্থীদের জন্য, সে শিক্ষার্থীরা বিদেশে নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য কোটি টাকা জোগার করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের কোন ফান্ড থেকে সহায়তা মিলেনি তার জন্য।বহু জায়গায় আমি আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছি। লক্ষ্মীপুর জেলার তৎকালিন ইউএনও নুরজ্জামানও তাঁকে দেখতে গিয়েছেন খালি হাতে। এই লজ্জার দায় কার আমার জানা নাই। ২০১৮ সালের ১৮অক্টোবর ঠিক এই মাসেই স্যার চলে গেলেন যত অভিমান নিয়ে না ফেরার দেশে। হাসপাতালের বিচানায় যন্ত্রণায় কাতর স্যারের সেই করুন মৃত্যু আজও  আমাকে নাড়া দেয়।স্যারের নিথর দেহটি নিজ হাতে রেখে আসলাম কবরে।

বেঁচে থাকতে স্যাকে আমরা পদক দিতে পারিনি। অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারিনি। স্যারের মৃত্যু যন্ত্রণারও ভাগ নিতে পারিনি কেউ, কিন্তু সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে মন্ত্র, সেটি নিয়েছি স্যারের কাছ থেকে। আমাদের হৃদয়ে যে প্রিয় শিক্ষককের সম্মান দিয়েছি আমরা, সেটিই স্যারের আজীবনের অমর সম্মাননা। সেটিই একজন মেঠোপথের আলোর দিশারীর প্রকৃত সম্মানন। মরণোত্তর এমন কোন স্মাননা থাকলেও আমি দাবি জানাই স্যারের জন্য, যদি অন্তত তার ঋণ আমরা কিছুটা শোধ করতে পারি। ওপারে ভালো থাকুন প্রিয় শহীদউদ্দিন স্যার।

লেখক: শিক্ষার্থী মার্স্টাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্ট (আইআর ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্যোক্তা ও অন্যতম সংগঠক `নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন’।

Print Friendly

Related Posts