পুলিশের তদন্তে ‘ভূতুড়ে আসামি’, রহস্য উন্মোচনে বরিশাল পিবিআই’র সাফল্য

উজিরপুরের স্কুলছাত্র নয়ন হত্যা

খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল ব্যুরো: একের পর এক নাটকীয় মোড় আর জট খুলছে উজিরপুরের স্কুলছাত্র নয়ন হত্যার। স্থানীয়দের হাতে মূল হোতা আটকের পর উপজেলা থানা পুলিশের ঢিমেতালে তদন্তের প্রতিবেদন যখন বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না তখন নতুন করে মামলার জট খুলতে মাঠে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

থানা থেকে পিবিআইতে মামলা আসার ১৫ দিনের মধ্যে হত্যায় সরাসরি জড়িত একজনকে আটক করে পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। অথচ পিবিআইএর হাতে আটককৃত আসামী বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের তদন্তে নামই আসেনি।

মামলার বাদী ও নিহত নয়নের পিতা ওসমান দাবী করেছেন, শুরু থেকেই পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করছিল। মূল খুনিদের বাদ দিয়ে চেনা-জানা নেই এমন তিনজনকে তদন্তে অভিযুক্ত করা হয়। আমি বারবার বলেছি, পুলিশের তদন্তে যে ৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ছিল খুনি। বাকিদের এলাকাবাসীই চেনে না; হত্যা মামলায় আসলো কেমনে জানি না। তবে পিবিআইএর তদন্তের দৃশ্যমান গতিতে সন্তুষ্ট সন্তানহারা সোবাহান।

তদন্তে উঠে এসেছে, উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠি গ্রামের বাসিন্দা ওসমান হাওলাদারের পুত্র আশিক হাওলাদার (২২), আমিনুল ইসলাম আমিন (১৭) ও ভরসাকাঠির বিপরীতে একটি খালের ওপার বাবুগঞ্জ থানার রমজানকাঠি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক সেনা সদস্য ইদ্রিস মিয়ার ছেলে মোমিন (১৭) একসাথে চলাফেরা করতো। এরা নিয়মিত ড্যান্ডি সেবন করতো। এরমধ্যে আশিক হাওলাদারের ড্যান্ডি সেবনের চিত্র দেখে ফেলে তার চাচাতো ভাই সোবাহান হাওলাদারের ছেলে বামরাইল এবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র নয়ন হাওলাদার। ড্যান্ডি সেবনের কথা আশিকের পিতার কাছে ফাঁস করে দেয় নয়ন। এতে আশিক ক্ষিপ্ত হয়ে তিন বন্ধু মিলে ‘নয়নকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার’ পরিকল্পনা করে।

চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল সকালে ড্যান্ডি সেবনের তথ্য ফাঁস করার পর দুপুরে বাড়ির পাশের একটি ব্রীজের ওপর বসে হত্যার পরিকল্পনা করে আশিক। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ি থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ডেকে নেয় আশিক। পিবিআইয়ের কাছে সর্বশেষ আমিনুল ইসলাম আমিন আটক হওয়ার পর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উলে­খ করেছেন, আশিক ডেকে নেওয়ার পর ভরসাকাঠি গ্রামের গীর্জাঘর নামক একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে নয়নের হাত, পা ও মুখ বেধে ফেলে রাখে। সেখানে মারধর করা হয় বলেও জানায়। একপর্যায়ে নয়নের মোবাইল ফোন নিয়ে চট্টগ্রামে থাকা নয়নের মা-বাবার কাছে কল করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপন দাবী করে। অন্যথায় নয়নকে মেরে ফেলা হবে বলেও জানায়।

এদিকে রাত ৯টার দিকে গীর্জাঘরের পাশের নদী পার হয়ে রমজানকাঠি একটি পাটক্ষেতের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় অপহৃত নয়নকে। সেই পাটক্ষেতটি অপর আসামী মোমিনের বাড়ির পিছনে। জবানবন্দীতে আমিন জানিয়েছে, পাটক্ষেতে নেওয়ার পরপরই ইট দিয়ে নয়নের মাথায় আঘাত করে আশিক। তখন আমিন ও মোমিন আহত নয়নের হাত পা চেপে ধরে। আর আশিকের সাথে থাকা ছুরি দিয়ে মাটিতে পরে যাওয়া নয়নের গলায়, ঘাড়ে উপুর্যপরি কোঁপাতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত নয়নের মৃত্যু নিশ্চিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোপায় আশিক। নয়ন মারা গেলে একটি বস্তায় ভরে, বস্তার সাথে ইট বেধে খালে ফেলে দেয়।

তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইএর পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান জানান, হত্যাকান্ড সংগঠিত করার পর অপরাধীরা বাড়িতে ফিরে আসে। নয়ন, আশিক ও আমিনের বাড়ি পাশাপাশি। অপরাধীরা খুনের পর ওই রাতে ঘরে এসে ঘুমায়।

তদন্ত সূত্রের বরাত দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, সকালে লাশ উদ্ধারের খবরের পরও স্বাভাবিক ছিল অভিযুক্ত খুনিরা। আশিকের পায়ে রক্তের দাগ লেগে থাকায় তাকে আটক করে পুলিশে দেয় প্রতিবেশীরা। তখন আশিক স্বীকার করে হত্যাকান্ডের কথা।

মাহফুজুর রহমান বলেন, থানায় আশিক তার সাথে তিনজনের নাম বলে। যদিও যাদের নাম বলেছে তাদের সাথে সম্পৃক্ততার সূত্র স্পষ্ট নয়। তবে আমরা আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখছি বিষয়টি।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, আশিক যে তিনজনের নাম বলেছে তারাও ড্যান্ডিসেবী। একসাথেই নেশা করে। কিছুদিন আগে ওই তিনজনের সাথে আশিক, আমিন ও মোমিনের সাথে ঝামেলা হয়। সেকারনেও ওই তিনজনের নামও বলতে পারে। তবে তাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলে জানান মাহফুজ। ওদিকে বাবুগঞ্জ থানা পুলিশ যখন নয়ন হত্যার তদন্ত করছিল তখন নয়নের পিতা সোবাহানকে পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দেয় মোমিনের পিতা সাবেক সেনা সদস্য ইদ্রিস।

সোবাহান বলেন, আমি শুরু থেকেই পুলিশকে বলেছিলাম আশিক যাদের কথা বলছে তারা খুনি নয়। এই কথা বলার পর ইদ্রিস আমাকে তিন লাখ টাকা প্রস্তাব দেয়-যেন মোমিনের বিষয়ে কিছু না বলি। এমনকি পুলিশও চাচ্ছিল না আমিন ও মোমিন আসামী না হোক। যখন আমি মানছিলাম না তখন আমাকে পিটিয়ে পা ভেঙ্গে দেয়। আসলে ছেলে হত্যার বিচার চাওয়ায় আমাকে পিটিয়ে পঙ্গু করার চেষ্টা চালায় খুনির পরিবার।

সোবাহান আরও বলেন, নয়ন খুন হওয়ার পর স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কারনে পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করেনি। যদি আমরা আশিককে ধরে না দিতাম তাহলে কোনদিনও খুনিদের সনাক্ত করা যেত কিনা তাও অনিশ্চিত ছিল। ভুক্তভোগী সোবাহান বলেন, পিবিআই সৎভাবে এবং দ্রুততার সাথে আমার ছেলে হত্যার মূল কাহিনী উদঘাটন করেছে আর প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার করছে।

ওদিকে পিবিআইএর পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, হত্যায় আরও কয়েকজন জড়িত থাকতে পারে। বেশ কয়েকটি সূত্র এখনো মেলেনি। আমরা সেই সূত্র ধরে কাজ করছি। আশা করি অল্প সময়েই বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে।

তিনি বলেন, পুলিশের তদন্তে যখন আমিন ও মোমিনের নাম আসছিল না তখন তারা নিরাপদে এলাকা ছাড়ে। আমিনের মা নারায়নগঞ্জের ফতুল­ার ভোলাইয়ার মিষ্টির দোকান এলাকায় আশ্রয় নেয়। তদন্তে নেমে বিষয়টি জানতে পেরে আমিনের চাচাকে নজরদারীতে নেই। শেষে তারসূত্র ধরে প্রথমে আটকের চেষ্টা চালাই। কিন্তু আমাদের তথ্য আগেই জানতে পেরে দ্রুত বাসা পাল্টায় আমিনের মা। যে ভ্যানওয়ালা আমিনদের বাসার তৈজসপত্র বহন করে নতুন বাসায় নেয় তার মাধ্যমে নতুন বাসা থেকে আটক করা হয়। এখন পর্যন্ত তদন্তে উঠে আসা তিনজনের মধ্যে দুজন কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছে একজন। তবে হত্যাকান্ডে ৭ জন অংশ নিয়েছে বলে সূত্র পেয়েছে পিবিআই বলেও জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠী গ্রামের বাসিন্দা দশম শ্রেনীর ছাত্র ইসরাফিল হাওলাদার নয়নের (১৫) বস্তাবন্দী লাশ সন্ধ্যা নদীর রমজানকাঠী নামকস্থান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। নয়ন ভরসাকাঠী গ্রামের সোবাহান হাওলাদারের পুত্র ও একই উপজেলার বামরাইল অনাথ বন্ধু (এবি) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবা-মা চট্টগ্রাম শহরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করার সুবাধে নয়ন তার দাদা-দাদীর সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকতো। ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি নয়নকে বাড়ি থেকে কথা শোনার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে নয়ন নিখোঁজ ছিলো। ওইদিন গভীর রাতে চট্টগ্রাম অবস্থানরত নয়নের বাবা সোবাহান হাওলাদারের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নয়নের মুক্তির জন্য ২ লাখ টাকা দাবি করে অজ্ঞাত দুস্কৃতকারীরা। নয়নের বাবা মুক্তিপণের জন্য ফোন পেলে তিনি দুর্বৃত্তদের টাকা দিবেন জানিয়ে বরিশালের উজিরপুর নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পরে সকালে বাড়িতে এসে জানতে পারেন তার ছেলের লাশ পাওয়া গেছে।

Print Friendly

Related Posts