দীপাবলি-কালীপূজা-ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

অসিত রঞ্জন মজুমদার

 

awsit

হেমন্ত প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত। শিউলীঝরা প্রভাতে চড়া রোদে সামান্য ঘাম, রাতে একটু শীতের আমেজ, নবান্নের আগমন, নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ। শুরু হলো, বাঙালি হিন্দুদের উৎসবের মরসুম। পরপর দূর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা।  দীপাবলি ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, মা শক্তির আরাধনার পরিসমাপ্তিতে বিসর্জনের বাজনা থামতে না থামতেই দীপবলির দীপশিখায় চারিদিকে হয়ে ওঠে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায়। পাহাড়, পর্বত, আকাশ-পাতাল সর্বই এই মহাশক্তি পূজার মধ্যে খুঁজে পাই সমন্বয়ের ভাবধারা, তাই মক্তি ও শক্তিপূজা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধনের সমুজ্জ্বল প্রতীক। মায়ের প্রতিমা যেন প্রেরণারই জীবন্ত প্রতিমা।

মা কালীকে নিয়ে এ দেশে যে বিশেষ উৎসবটি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে সেটি দেওয়ালি বা দীপাবলি উৎসব। বাংলার প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে শহরে এই উৎসব প্রতি ঘরে ঘরে পালিত হয় বলেই যে কোনো উৎসবের চেয়ে এর মাদকতা ও ব্যাপকতা অধিক।

দীপান্বিতা আমবস্যার প্রধান আরাধ্য দেবী হলেন দক্ষিণা কালী। কালী করলাবন্দনা, মুক্তকেশী, মহামেঘের মতো তাঁর বর্ণ। মুখে বিকশিত দন্তপঙক্তি ভেদ করে বিস্মৃত লোলরসনা। দুই অধরপ্রাপ্ত বেয়ে পড়ছে রক্তধারা। গলায় মুক্তমালা, কর্ণে শিশুশবের কর্ণ ভুষণ। মা কালীর চর হাত। বাঁদিকে উপরের হাতে রক্তমাখা খোপানসী খড়স, নিচের হাতের সদচ্ছন্দ মুন্ড। ডানদিকের হাতে দুটিতে অভয় ও বর। নরকরের মেঘলা থাকলেও দেবী দিগম্ববী, ঘোর শব্দ বিস্তার করে ঈষা হাস্যমুখে শবরূপী, মহাদেবের বুকে পা রেখে তিনি যেন নিত্য করছেন। আপাতদৃষ্টিতে মা কালী ভীষণ ভয়ংকরী।  ভক্তের দৃষ্টিতে তিনি সর্বময়য়সর্বঙ্গলা সুন্দরী। তিনি অভয়পানি দুরিতহারিণী, তিনি মাধুর্যময়ী, মহাবিদ্যা, মহাশক্তি। বাঙালি মা কালী অন্তপ্রাণ। মা কালী তাঁর জীবনের প্রেরণা, কর্মে শক্তি বিপদের আশ্রয়। মা শক্তির আরাধনার পরিসমাপ্তিতে দীপাবলির দীপশিখায় চারিদিক হয়ে ওঠে উজ্জ্বল আলোয়। এই আলোর উৎসবের আলোয় আলোকিত হয়ে আপাময়ী মানুষের হৃদয়মন। সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে পারিপার্শ্বিক দীপাবলির আলো শুধু সজ্জা নয়, তার আড়ালে আছে এক জীবন্ত প্রতীক। অন্ধকারকে জয় করার উদ্যম ইচ্ছাটুকুই ফুটে ওঠে আলো আলোয়। উৎসবের এত আলোর মধ্যে বহু হাজার বছরের সাধনার রঙিন একটা ছবি মনের গভীর থেকে একেবারে চোখের সমানে বাস্তব হয়ে জেগে ওঠে। অন্ধকারকে জয় করার অদম্য ইচ্ছাটুকুকে ফুটে ওঠে আলোয় আলোয়। আমাদের কালী মা যেন সব কালীমা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে চান। দীপাবলি উৎসবের আলোকসচ্ছায় আমরা যের কাউকে খুঁজতে থাকি। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার তিথিতে মা কালীর আরাধনার জন্য দীপাবলি উৎসব। আর ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মৃত্যুর অধিদেবতা যমকে বা অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ বা বিতাড়িত করার আকুতি করে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু সৌভাগ্য কামনা করে বোন যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়া, বোন কর্তক ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় এইখানে প্রধান বস্তু।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠানটি একটু বেশি জমজমাট। সব দিক দিয়ে বিচার করলে এই উৎসবটিকে বাঙালি হিন্দুর শ্রেষ্ঠ সামাজিক অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে। শুভদিনের পরম পবিত্র লগ্নে ভাই-বোনের মধুর সম্পর্কের পুনঃ নবীকরণ করে নেওয়া হয় প্রতি বছর। শৈশবের হারিয়ে হাওয়া মধুর স্মৃতিগুলো যেন এই দিনটিতে বড় বেশি করে মনে পড়ে যায়। ভাই-বোনের ¯েœহ ভালবাসার সম্পর্কের প্রকাশ ভাইফোটার আচার অনুষ্ঠানটি মন কেড়ে নেয়। একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চিরন্তন আবেগ অনুভ‚তিই জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভাই-বোনের সম্পর্ক তো চিককালীন। বিয়ের পর সঙ্গত সামাজিক কারণে ভাই-বোনের বিচ্ছেদ ঘটেই। এই বিচ্ছেদে প্রতি বৎসরই মিলন ঘটবেই। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সঙ্গে মিলতে পারি মনের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি।

কার্ত্তিক মাসের শুক্লা পক্ষে দ্বিতীয় তিথিতে বোন তার ভাইকে পরম যত্ন ও ভক্তি সহকারে একটি সুন্দর আসনে বসান। শিশির ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে হাতের তিন আঙ্গুলের সাহায্যে বোন তার ভাইয়ের কপালে ধুয়ে দেয়। এই কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে একইভাবে চন্দন তিলক এঁকে দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করে-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়লো কাটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দিই ভাই ফোঁটা।

শরতের পবিত্র শিশির দিয়ে বোন তার ভাইয়ের সব অশুভ অমঙ্গল ও অকল্যাণকর শক্তিকে ধুয়ে দেয়। সুগন্ধি চন্দন তিলক ললাটে এঁকে দিয়ে এনে দেয় সৌভাগ্যের পরশমনি। তারই সঙ্গে অমরত্নের প্রতীক দুর্বা আর ধনের প্রতীক ধান দিয়ে প্রার্থনা বা আর্শীবাদ করে ভাইয়ের সব কল্যাণের জন্য। অন্যদিকে ভাই বোনকে আর্শীবাদ বা তার মঙ্গল কামনা করে। ভাই-বোনের এই আকুতিইে তো ভাই ফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

অনাচার, অত্যাচার আর বঞ্চনা এই সংসারে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক যত পার্বণই থাকুক না কেন ভাইফোঁটার এই অনুষ্ঠানটি যেন একটু জমজমাট অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে একটি মঙ্গলজনক সামাজিক বন্ধন। এইখানে ভাই-বোনের মমত্ববোধ ও এঁকে অপরের মঙ্গল কামনাই প্রধান অধ্যায়। ভাই-বোনের দীর্ঘায়ু ও সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবন কামনায় মৃত্যুর অধিপতি যম দেবতার দুয়ারে যে আকুতি প্রার্থনা করেছেন তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উৎসব। বোনের আকৃতি বিরল একটি ভূমিকা।

সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই মানুষ প্রকৃতির অপার লীলায় নিজে নিজেই আভিভূত হয়ে বিস্ময় ও বিমুগ্ধ চিত্তে ভালোবাসার স্ততি রচনা করে। হৃদয় অর্ঘ্য নিবেদন করে নিজেকে লুটিয়ে দিয়েছে বিচিত্র শক্তিময়ী প্রতীকীর পাদপদ্মে। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হচ্ছে এমন একটি উৎসব যেখানে মিলনের মহামেলার সূচনা হয় বাঙালির হিন্দুর জীবনে। বোন ভ্রাতৃপ্রতীকে আশ্রয় করে অবলম্বন করে ভালোবাসা নিয়ে হৃদয়ের সমস্ত শুভ ও সুন্দর আর্তিকে নিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ করে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে শুভশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার সাধনায় ব্রতী হয়।

সারা উত্তর ভারতে দীপাবলিই প্রধান উৎসব।  দীপাবলি বা দেওয়ালি ৫ দিনের উৎসব। ত্রয়োদশীর দিনে থেকে শুরু হয়-সে দিনটিকে বলা হয় ধনতেরস। এই দিনে সকালে কোনো একটা মূল্যবœ ধাতুর জিনিস কিনে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। এই দিনে পাঁচটা প্রদীপ জ্বালানো হয়-পঞ্চভ‚তের উদ্দেশ্যে, জল, মাটি আকাশ, বাতাস ও আলোকে স্মরণ করে।

দ্বিতীয় দিন ছোট দিওয়ালি-এই দিন চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয় ও নরকাসুর বা বলিরাজার পূজা হয়। তৃতীয় দিন অমাবস্যার বলি দেওয়ালি পালন করা হয়। কথিত আছে যে এই দিন রামচন্দ্র চৌদ্দ বৎসর বনবাসের পর সীতা ও লক্ষণকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। তাদের ফিরে আসায় অযোধ্যা নগরের বাসিন্দারা আনন্দের মেতে উঠেছিল এবং সেই আনন্দ প্রকাশ করার জন্য তারা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা নগর সাজিয়ে ছিল। সীতা ফিরে আসায় যেন এই দিন অযোধ্যায় লক্ষ্মী ফিরে এসেছিল এবং রাম এরপর তার আদর্শ রাম রাজত্ব স্থাপন করেছিল। সে জন্য এই দিন লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা করা হয়। উত্তর ভারতের ব্যবসায়ীরা এই দিনেই হালখাতা করে থাকেন।

চতুর্থ দিনে গিরি গোবর্ধন পূজা করা হয়।

পঞ্চম দিন মাসে শেষ দিন যমদ্বিতীয় বা ভাইদুজ পালন করা হয়। বাঙালি হিন্দুরা এঁকে বলে ভাইফোঁটা।

হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ারা বর্ণনা পাওয়া যায়। মার্কেন্ডেয় পুরান ভ্রাতৃদ্বিতীয়ারা উল্লেখিত আছে। ঋণ বেদে যম ও যমুনার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ পুরান বলা হয়েছে যমী (যমুনা) তার ভাই যমকে কার্ত্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে নিজ গৃহে এনে পূজা করে ভোজনে আপ্যায়িত করেছিলেন। জনশ্রæতি আছে সেই থেকেই ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার উৎসব পালন হয়ে আসছে। অন্যদিকে ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে আচার্য্য সবানন্দ সুরীর  দিপাৎসবকল্প নামে এক পুঁথি রচনা করেন, পুঁথির শেষ শ্লোকে বলা হয় মহাবীরের জবিনবাসন হলে রাজা নন্দী বর্ধন বোনের শোক নিবারণের জন্য বোনকে বুঝিয়ে আদর যত্ন করে আপ্যায়ন করেছিলেন। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া একটি মঙ্গলজনক সামাজিক বন্ধন। এখানে শুধু ভাইবোনের মমত্ববোধ একে অপরের শুভ কল্যাণ কামনাই মুখ্য।

দীপাবলির উৎসবের মধ্যে মা কালীর আরাধনায় মৃত্যুর অধিপতী যমের বিতাড়ণ ও অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ অন্যদিকে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া যমের দুয়ারে কাঁটা দিয়ে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু ও সৌভাগ্য কামনা করা হয়।

অত্যাচার অনাচার নির্যাতন আর বঞ্চনার এই সমাজে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এক মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজের অবহেলিত পীড়িত দুর্গত ও অসুস্থ মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ জাগিয়ে দিয়ে একে অন্যের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার অংশীদার হিসেবে একে অন্যের সেবার মাঝে নিয়োজিত থেকে একটি আদর্শ সুখী শান্তিময় সমাজ গড়ে পারি।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এই শুভ দিনে হোক আমাদের অঙ্গীকার-আমরা আমাদের সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভাই-বোন হিসেবে বরণ করে গড়ে তুলব সুখী শান্তিময় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

পৃথিবীর সকল প্রাণি হোক সুখী ও সমৃদ্ধশালী।
ঔঁ শান্তি। ঔঁ শান্তি। জয় মা কালী।

 

অসিত রঞ্জন মজুমদার: মহাসচিব, বাংলাদেশ হিন্দু যুব কল্যাণ সমিতি

awsitam@gmail.com

Print Friendly

Related Posts