সাকিব নিষিদ্ধ হচ্ছেন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ দেশের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান আইসিসির ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে যাচ্ছেন। দুই বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে এক ক্রিকেট জুয়াড়ির (বুকি) কাছ থেকে অনৈতিক প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাকিব। সেটি তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করলেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে না জানিয়ে গোপন করেন তিনি। বিষয়টি পরে আইসিসি জানতে পারে। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের কল রেকর্ড ট্র্যাকিং করে এ ব্যাপারে তারা তথ্য উদ্ধার করে। ওই জুয়াড়ি আইসিসির কালো তালিকায় থাকাদের একজন। বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর সম্প্রতি সাকিবের সঙ্গেও কথা বলেন আইসিসির অ্যান্টিকরাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট (আকসু) প্রতিনিধি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সাকিবও নিজের ভুল স্বীকার করেছেন আকসু তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, জুয়াড়ির প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেননি বলেই জানাননি। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়াটাই তার জন্য  কাল হয়েছে। সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন তিনি। বিসিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আজ অথবা আগামীকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানাবে আইসিসি। বিসিবি এরই মধ্যে এ বিষয়ে অবগত হয়েছে।

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ইতোমধ্যে একাধিক ব্রিফিং ও সাক্ষাৎকারে ৩০ অক্টোবর আইসিসির একটি রিপোর্ট পাওয়ার কথা বলেছেন। গত ২২ অক্টোবর মঙ্গলবার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিষয়েও ইঙ্গিত দেন তিনি। সাকিব যে ৩০ অক্টোবর দলের সঙ্গে ভারত যেতে পারছেন না, সেটিও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বিসিবি সভাপতি। ভারত সফরে নতুন অধিনায়ক পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাও উল্লেখ করেছেন পাপন। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এত কিছুই ঘটেছে সাকিবের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞাকে সামনে রেখে।

আইসিসি ইতোমধ্যে সাকিবের ব্যাপারে বিসিবিকে বিস্তারিত জানিয়েছে। তাকে জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলন না করার নির্দেশনাও দিয়েছে আইসিসি। এ কারণে অসুস্থ বলে জাতীয় দলের অনুশীলনে যোগ দিচ্ছেন না সাকিব। গতকাল সোমবার বিসিবির একাধিক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাকিব পরবর্তী সময়ে আকসুকে সহায়তা করায় একটু নমনীয় তারা। শাস্তি ১৮ মাস নির্ধারণ করা হলেও সাকিব আপিল করলে সেটা কমিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বিসিবির সহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি সাকিব আইসিসির কাছেও ক্ষমা চেয়ে শাস্তি মওকুফের আবদেন করবেন। আইসিসি দুর্নীতি দমন বিভাগের নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চললে এই শাস্তি ছয় মাসে নেমে আসতে পারে। এটাই এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন শাস্তি।

আইসিসির দুর্নীতি দমন নীতিমালায় আছে, কোনো ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, আম্পায়ার, স্কোরার, গ্রাউন্ডসের সদস্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংশ্নিষ্ট যে কেউ জুয়াড়ির কাছ থেকে যে কোনো ধরনের প্রস্তাব পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা আইসিসি বা সংশ্নিষ্ট দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। যতটা দ্রুত সম্ভব সেটা করার নির্দেশনা আছে। এজন্য প্রতিটি সিরিজ বা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আইসিসি থেকে ক্রিকেটার এবং অফিসিয়ালদের সচেতন করতে জুয়াড়িদের সম্পর্কে অবগত করা হয়। আইসিসির তালিকাভুক্ত জুয়াড়িদের ছবি ও ফোন নম্বর টানিয়ে দেওয়া হয় ড্রেসিংরুমের পাশে। প্রতিটি আন্তর্জাতিক সিরিজে আকসুর সদস্য উপস্থিত থাকেন। বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেট মৌসুম শুরুর আগেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের নির্দেশনা মেনে খেলোয়াড়, টিম অফিসিয়াল, ম্যাচ অফিসিয়াল এবং গ্রাউন্ডস কর্মীদের সচেতন করা হয়। এ কাজটি করেন বিসিবির দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা মেজর (অব.) মোর্শেদুল ইসলাম। ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা এবং জুয়াড়িদের ছায়া থেকে দূরে রাখতে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ দলের সঙ্গে রাখা হয়েছিল তাকে।

ফিক্সিং প্রতিরোধে আইসিসির সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলোতে সাকিব বরাবরই উপস্থিত ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে চালু হওয়া ‘আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস’ ভালোই জানা বাংলাদেশ অধিনায়কের। এই নিয়ম অনুসরণ করে আগে একবার জুয়াড়ির ফোন পাওয়ার বিষয়ে আকসু ও বিসিবিকে জানিয়েছিলেন তিনি। অথচ সেই সাকিবই কি-না দুই বছর আগে এত বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন। বিসিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, সাকিবকে শাস্তির ব্যাপারে জানিয়েছে আকসু। এ ব্যাপারে বিসিবিও আইসিসির ই-মেইল পেয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে সাকিবের পাশেই থাকবে বিসিবি। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজামউদ্দিন চৌধুরীর ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য আইসিসি থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো ই-মেইল প্রাপ্তির কথা নিশ্চিত করেননি। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে একাধিকবার ফোন করে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস করলেও কোনো উত্তর আসেনি। পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আইসিসি থেকে একটা কিছু আসবে শুনেছি। তারা কী পাঠাবে, জানি না।’

একইভাবে দু’দিন ধরে পর্যায়ক্রমে সাকিব আল হাসানের মোবাইলে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দিলেও নীরব থেকেছেন সাকিব। তবে তার একান্ত ঘনিষ্ঠ চারজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। নাম গোপন রাখার শর্তে তাদের সবাই জানিয়েছেন, যেভাবেই হোক আকসুকে রিপোর্ট করতে ভুলে গিয়েছিলেন সাকিব। পরে আকসু থেকে বিষয়টি ধরা পড়ে। সাকিব নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। শাস্তি ঘোষণার পর তিনি আকসুর কাছে আবেদন করলে বিবেচনা করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।

আকসুর নিয়মে আছে, কোনো ক্রিকেটার, ম্যাচ অফিসিয়াল, টিম অফিসিয়ালসহ সরাসরি ক্রিকেটে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনৈতিক প্রস্তাব না জানিয়ে চেপে গেলে, লুকানোর চেষ্টা করলে বা আকসুর জিজ্ঞাসাবাদেও অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে ‘আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন’ ধারা ২.৪.২, ২.৪.৩, ২.৪.৪, ২.৪.৫ ও ২.৪.৬ কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ছয় মাস আর সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে আইসিসি। সাকিব আকসুর জিজ্ঞাসাবাদে সহযোগিতা করায় ১৮ মাস শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আপাতত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে আইসিসি।

বিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, স্পট ফিক্সিং বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি বা অভিযোগও তোলা হয়নি। আইসিসি পরিস্কার জানিয়েছে, সাকিব জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি জানাননি। এতেই আইন ভাঙা হয়েছে। তবে সাকিব কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আকসু ভালো করেই জানে, সাকিব ক্রিকেটে যে কোনো অনৈতিক বিষয়কে ঘৃণা করেন। তিনি এও বলেন, ‘সাকিবের কেসটা মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো নয়। তবে এটা অবশ্যই এ দেশের ক্রিকেটের জন্য বড় দুঃসংবাদ।’

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আকসুর তদন্ত এবং শাস্তির ইস্যুতে সাকিব আল হাসান গত দু’দিন বৈঠক করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে। গত বৃহস্পতিবার আর রোববার পাপনের ধানমন্ডির কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাকিব নিজের ভুল স্বীকার করে বিসিবির সহযোগিতা চেয়েছেন বলেও জানান এক কর্মকর্তা। সাকিবের কাছ থেকে ঘটনা জানার পর পাপনও হতবাক। সাকিবের মতো একজন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার এমন ভুল করতে পারেন, ভাবতেও পারছেন না তিনি।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভেতরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ক্রিকেটারদের কল রেকর্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ভারত সফর বানচালের যে ইস্যু সামনে এসেছে, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্রিকেটারদের ধর্মঘট ও আন্দোলনের পেছনে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মালিক লুৎফর রহমান বাদলের ইন্ধন ও সম্পৃক্ততার কথা শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে বাদল ইংল্যান্ডে আছেন। সন্দেহজনক সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান বিসিবির এক প্রভাবশালী পরিচালক। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, সাকিব ছাড়াই আপাতত ভারত সফরে যেতে হবে বাংলাদেশ দলকে।

সূত্র : সমকাল

Print Friendly

Related Posts