সত্তুরের সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর

মোকাম্মেল হক মিলন: ঐতিহাসিক ১২ নভেম্বর আজ ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস উপকূলীয় অঞ্চলসহ ভোলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল। সেই স্মৃতি আজো যারা বেচে রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে যারা আত্মীয় স্বজন হারিয়েছেন সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই আতঙ্কে উঠছেন।

৭০ সালের সেই ঘটনার প্রবাহ সংক্ষিপ্তভাবে নিয়ে প্রদত্ত করা হয় বিগত শতাধিক বছরে হিসেবে উপমহাদেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলোর মধ্যে ৭০ এর ঘূর্ণিঝোড় সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছিলো। ধারনা হচ্ছে প্রলয়ংকারী ঐ দূর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো তম্মধ্যে ভোলা জেলায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিলো। আর অসংখ্য জনপদ বিরান হয়েছে ও উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরত হয়েছিল লাশের নদীতে, সেকি ভয়াবহ দৃশ্য।

৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে লাগলো। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে লাগলো এবং মাঝরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে লাগলো সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসলো পাহাড় সমান সমুদ্রের ঢেউ। ৩০/৪০ ফুট উচু ঢেউ আছড়ে পড়ল জনমানুষের উপর। আর মূহুর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে গেলো মানুষ, গবাদিপশু, বাড়ীঘর এবং ক্ষেতের সোনালী ফসল। পথে প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে পড়েছিলো কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে যে লাশ তার কোন ইয়ত্তা নেই।

৭০ কালো রাতের কথা মনে হলে ধূসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসে হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক ও বাংলাদেশ বেতার প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। মাতা শিশু কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডাল এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা ও চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে।

জনমানুষ শুন্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা। ভোলা প্রেসক্লাবের সদস্য জহিরুল ইসলাম মঞ্জুর সেই সময় ঘূর্ণিঝড়ে মা সহ ভাই বোনেরা চরফ্যাশনে প্রাণহানী ঘটেছিল। যা আজও তার মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। তিনি সেই সময় যা দিয়ে প্রাণহানী ঘটেছিল তাদের সকলের শোকাবহ পরিবারের শান্তি কামনা করছেন।

সেই সময়কার প্রকল্পকারী ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছাসে ভোলার সমস্ত জনপদকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়োছিলো আর নদীতে গবাদি পশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়েছিলো এবং সংবাদ তৎকালীন “পূর্বদেশ” পত্রিকার ভোলাস্থ প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন “বাংলার মানুষ কাদোঁ। ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ” শিরোনাম ছাপা হয়েছিলো। আর এ সংবাদ বিশ্বব্যাপী চারদিন পর জানতে পেরেছিলো। সেই পত্রিকার চিত্রটি আজো ঢাকা প্রেস ইনষ্টিটিউট-এ কালের স্বাক্ষী হিসাবে বাধানো অবস্থায় প্রদর্শিত হচ্ছে।

কোষ্টট্রাষ্ট আয়োজনে সেপ্টেম্বর’১৯ উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রো ফরেষ্ট তৈরীর জন্য করণীয় শীর্ষক এক সেমিনারে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মমিন টুলু বলেছিলেন ৭০ ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভোলা এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহম্মেদ, অধ্যক্ষ মোফাজ্জল হোসেন শাহীনসহ একদল নেত্রীবৃন্দের সাথে ছাত্রনেতা হিসেবে আমিও দেখেছিলাম বীভিশিখাময় সেই দৃশ্য আজোও তার মনে পড়তেই আতঙ্কে উঠি। সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভোলার চতুদিকে বেরিবাধ নির্মাণ আর উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রো ফরেষ্ট নির্মাণে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার পথে সুন্দরবন যেভাবে বাংলাদেশের জনগনকে রক্ষা করেছিল তেমনি ভোলার চর কুকরি-মুকরি, ডালচর, চর নিজামসহ বিভিন্ন ম্যানগ্রো ফরেষ্ট ভোলা বাসীকে ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আসছে।

জলবায়ূ ফোরাম ভোলা জেলা কমিটির সভাপতি নূর ইসলাম, সাধারন সম্পাদক সাফিয়া খাতুন, সদর উপজেলা জলবায়ূ ফোরাম সভাপতি মোকাম্মেল হক মিলন, সাধারন সম্পাদক অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা এবং কোস্ট স্ট্রাস্ট জলবায়ূ ফোরাম টিম লিডার রাশিদা বেগম, ভোলার উপকূলীয় অঞ্চল সমূহে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে বেশি করে বৃক্ষরোপন করার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের ও টেকসই স্থাপনা স্থাপনের দাবী জানিয়েছিলেন।

জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক একবার্তায় ভোলা উপকূলীয় অঞ্চলের সকল মানুষকে যেকোন বিপদ মুহুর্তে বিশেষ করে বুলবুল, আইলা, সিডর, ফনীসহ বিভিন্ন নিম্নচাপ ও ঘূণিঝড়ের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।

এই দিবসটি পালন উপলক্ষে গত বছর কোস্ট স্ট্রাস্ট ভোলা চরফ্যাশন উপজেলায় এক বিশাল র‌্যালি আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এবছর দিনটি স্মরনে ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরআনখানী ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে মুনাজাত করা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।

 

Print Friendly

Related Posts