জীবন হোক নিরাপদ ॥ জুঁই জেসমিন

কোথায় নিরাপদ জীবন? আমরা এমন এক যুগে চলমান, দৈনন্দিন ছুটতে হয় দিগ্বিদিক জীবনের প্রয়োজনে। কারও জীবন ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আর কবিতাতে চোখ বুলানোর সময়ও নেই, নেই গল্প পড়ার কিংবা রূপকথার গল্প শোনার, নেই রবিঠাকুরের রচনাবলী ছুঁয়ে দেখার।

ব্যস্ত মানুষ, ব্যস্ত জনপদ তবে তা নিরাপদ জীবন ভুলে। গতর খাটানো কাজ ক্রমশ নেই বললেই চলে এ যুগে। কাঁচা মাটির নির্যাস বা ঠাণ্ডা কোমল অনুভূতি কজন নিই বা পেয়ে থাকি? শুধু কৃষাণরা এই সুযোগ ভোগ করে থাকে মাত্র।

মান্ধাতার আমলে খুব বেশি যানবাহন ছিলোনা। স্থানান্তরে পায়ে হেঁটেই মূলত এক এলাকা হতে আর এক এলাকায় যাওয়াআসা হতো। তারপর ধীরে ধীরে পালকি, ঘোড়া গাড়ি, গরু গাড়ি, উট, কাঠ বা ভেলা এসব জল ও স্থল পথের পরিবহণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সেকালে মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য পশু পালন, পশু শিকার আর কৃষিই ছিলো প্রধান কাজ, যার কারণে বেশি দূরে যাওয়া লাগতো না। আর নারীদেরও এখনকার যুগের মতো বাইরে কাজ বা চাকরি ছিল না। পুরুষরাই শুধু বের হতো কাজের জন্য।

এখন শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষকে বের হতে হচ্ছে সময়ের দাবি পূরণে- শিক্ষা, চিকিৎসা, আয় রোজগারের প্রয়োজনে। কাজের তুলনায় মানুষের উন্নত জীবন যাত্রার তুলনায়, উন্নত পরিবহণ হচ্ছেনা আবিস্কার।

একটু ভেবে দেখুন, ট্রেন, বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল, বিমান এসব বাহন বাপ দাদার আমলেও ছিল আর এখনো তাই আছে, তবে চাকচিক্য ও সংস্কার হয়েছে মাত্র।

যে যুগে প্রতি পরিবার থেকে একজন বের হতো বাইরে, এখন কম বেশি প্রত্যেককেই বের হতে হচ্ছে ঘর থেকে। ছেলেমেয়েদের বের হতে হচ্ছে স্কুল, কোচিং এ, আর পরিবারের বাকিদের বের হতে হচ্ছে নিজ নিজ কর্মসংস্থানে।

শহর-উপশহর হাটবাজার, পথে, গাড়িতে, এতো এতো মানুষ, দুর্ঘটনা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। লঞ্চ, বাস, বিআরটিসি, ট্রেন ইত্যাদি বড় বড় সব সরকারি-বেসরকারি পরিবহণগুলোতেও যাত্রী বোঝাই, পা রাখার জায়গা পর্যন্ত থাকেনা।

সময়ের দাম রাখতে, ঠিক সময়ের হিসেবে নিজেকে নিরাপদ রাখতে ভুলে যায় মানুষ। নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ পরিবহন -চাই চাই করে চিৎকার করা হয় মানববন্ধনের মাধ্যমে মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে স্লোগানে, অথচ একটু ভুলে বা অসতর্কতায় বা অসচেতনতায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে নিরাপদ গাড়িতেও, নিরাপদ ট্রেনেও।

যেখানে সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহণ বাংলাদেশ রেল, যেখানে জীবন গড়ার জীবনকে আলোকিত করার মূল কারিগর শিক্ষক, এসবের মাঝে এখন ঘটছে অপ্রত্যাশিত বিপজ্জনক ঘটনা। যাচ্ছে প্রাণ হচ্ছে খুন ঘটছে যত্রতত্র অমানবিক ঘটনা।

বাস বা ট্রেন চালককে দক্ষ করতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন যথাযথ থাকলেও মূলত অসচেতনতা আছেই। এক একটি জীবন এখন যান্ত্রিকতার সাথে মিশেই চলছে, অনিমেষ ছুটছে সবাই, জীবনের শৈল্পিকতা, জীবন নামের স্বপ্নিল কারুকাজ মুছে, জীবনকে সৃষ্টি সাহিত্যে না রাঙিয়ে অর্থের নেশায় উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় যেন পথ চলা।

কায়িক পরিশ্রম হতে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশে নব নব বিজ্ঞানীরা ঝুঁকে পড়েছে রোবট বানাতে। তৈরি হচ্ছে নানান কাজের জন্য নানান ‘কর্মী রোবট। প্রযুক্তি যেমন মানুষকে আরাম প্রিয় করে তুলেছে তেমনি অলস বা শক্তিহীন করেও তুলছে। শক্তিহীন অপুষ্টিকর এক একটি জীবন, জল বিহীন মাছের মতো ছটপট করে মরছে নানাবিধ দুর্ঘটনায়।

গ্যাস সিলিন্ডার হতে অগ্নিপাত, বিস্ফোরণ, অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে বিদ্যুৎ ব্যবহার, আর রকমারি পরিবহনের ভিড়ে দৈনন্দিন আসে মৃত্যুর খবর।

বিজ্ঞানীরা যদি এমনটি চিন্তা করে যা কখনওই দুর্ঘটনা না ঘটে, এমন আবিষ্কার করতে এগিয়ে আসেন, যে পরিবহণ নিরাপদ ও শব্দবিহীন যা আকাশ পথ দিয়েই দ্রুত পৌঁছানো যায় এক বিভাগ হতে আর এক বিভাগে। এতে অন্তত দূষণ মুক্ত সমাজ পাওয়া যাবে নিরাপদ ও শৃঙ্খলা রূপে। অসম্ভব বলতে কিছুই নেই এই প্রযুক্তির যুগে। সবই সম্ভব শুধু মাত্র সৃজনশীল ভাবনায় পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে এগিয়ে যাওয়া বাকি মাত্র।

অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট যদি ১৯০৩ সালে বিমান আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে এ যুগে আরও উন্নত আবিষ্কার কেন সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। যে আবিষ্কার সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে সেসব আবিষ্কার হতে বিরত থেকে সমাজ ও দেশের মঙ্গলের জন্য ভাল কিছু আবিষ্কার করার কথা ভাবা শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে এই গুণের পরিচয়ে নিজেকে পেখম মেলতে হবে ।বেশি বেশি আকাশ পথে আকাশ পরিবহণ ব্যবহার হলে দুর্ঘটনা ও যান্ত্রিক জ্যাম, শব্দ দূষণ হতে মুক্তি পাওয়া অবশ্যই সম্ভব।

দিন দিন দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার চেয়ে নিহত হওয়ায় ভাল,কারণ পঙ্গুত্ব জীবনের চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে? এমন কোনো পরিবার বা তাদের আত্মীয় স্বজন নেই যা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হননি! বেশিরভাগ মানুষ অচল, দুর্ঘটনাজনিত কারণে।এই ভয়ংকর মহামারি অভিশাপ হতে রক্ষা পাওয়ার একটাই পথ নতুন নতুন নিরাপদ আবিষ্কার।

ছোটোখাটো অসংখ্য পরিবহণ আসাতে সমস্ত শহর যেন হিজিবিজি শহরে পরিণত হয়ে গেছে। পরিবহণের তুলনায় চালকের সংখ্যা খুব সীমিত। অধিকের চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চালক দেশে অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রশাসনিকভাবে প্রত্যেক পরিবহণের চালকদের, দক্ষ ডাক্তার দ্বারা চেকআপ করা অত্যন্ত জরুরী। গাড়ি ছাড়ার আগে, প্রেসার চেক, মানসিক অবস্থা, লম্বা জার্নি করার ক্ষমতা আছে কি না, ঘুমের প্রবণতা বা ঘুম ঘুম ভাব এমনটি থাকলে কোনো ক্রমেই ড্রাইভ করতে দেওয়া যাবেনা।

আরামপ্রদ পরিবহণ যার নাম ট্রেন। ইদানীং লাখো মানুষের প্রশ্নের ঝড়, এতো প্রাণ যাচ্ছে কেন ট্রেনে? জীবনের ঝুঁকি ভুলে সামান্য অর্থ বাঁচাতে গাড়ির ছাদে উঠা হয়। যা কোনো নিয়মের মধ্যে পড়েনা। ট্রেনের বগি গুলোতে সর্ব প্রকার সুবিধা থাকলেও বৃহৎ সমস্যা সিঁড়ির ক্ষেত্রে, প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে উঠতে নামতে হয় তাও আবার নিদিষ্ট এক টুকরো সময়ের মধ্যে। দুর্ঘটনার পিছনে চালক বা যাত্রীর অসচেতনতা থাকলেও বৃহৎ কারণ অনিরাপদ সিঁড়ি, এবং রেলপথ। ট্রেনে ওঠানামার সিঁড়ি অবশ্যই প্রশস্ত ও ঝুঁকিমুক্ত আবশ্যক । এই কেমিকেল যুগে কোনো ব্যক্তিই নিজ নিজ অবস্থান হতে পরিপূর্ণ সুস্থ না, ট্রেন জার্নি অত্যন্ত আরামদায়ক হলেও এই সিঁড়িপথে ওঠানামা প্রত্যেক যাত্রীর প্রচণ্ড কষ্ট হয়।

সিঁড়ি এমনটি হলে বেশ ভাল হয় যেমন; সুইচ অন করা মাত্রই প্রশস্ত সিঁড়ি বের হয়ে আসবে। আবার গাড়ি ছাড়া হলেই সুইচ অফ করতেই সিঁড়ি গাড়ির ভেতরে সেট হয়ে যাবে। এমন সিস্টেম হলে সবার জন্য বেশ সুবিধা ও নিরাপদ হবে। ক্রসিং পয়েন্ট ট্রেন যাত্রায় বেশ ভাবিয়ে তোলে এবং কি লম্বা সময় ধরে বেশিরভাগ ট্রেন থেমে থাকে অন্য এক ট্রেন ক্রস হওয়া না অবধি।

এই ক্রসিং পয়েন্ট সংস্কার বা পরিবর্তন করা অতি প্রয়োজন। যাতে আর ১২ নভেম্বরের সেই উদয়ন এক্সপ্রেস আর নিশিথার মতো সংঘর্ষ না হয়, দুমড়ে মুচড়ে না পড়ে আর কোনো পরিবহণ। সারি সারি লাশ আর আহতদের বাঁচার আর্তনাদ অত্যন্ত কষ্টদায়ক। একটু গাফিলতি আর সচেতনতার অভাবে ১৬ জন স্বপ্নিল মানুষের প্রাণ গেল, আহত হল শতাধিক মানুষ।

মাহিমা ছোট্ট শিশুটির কথা ভাবলেই হৃদয়ে কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়ে, বেদনার প্লাবনে। স্বজনদের ডানাতলে সিলেট থেকে ফেরার পথে, শিশুটি সেদিন হারিয়েছে তার স্বজনকে। এক একটি দুর্ঘটনা এক একটি ভয়াবহ শোকের সনদ আজ দুর্ঘটনা কবলিত পরিবারের।

এক ছোট্ট তাজুর কথা বলি, যার বাবা ছিলো দু চোখের নয়ন মনি। বাবা সারাদিন ভ্যান গাড়ি চালিয়ে মেয়ের জন্য নিয়ে আসতেন সুখের রত্ন টুকরো উপাদান, আনন্দের আকাশ। হঠাৎ তার বাবা ঢাকার উদ্দেশ্যে একদিন বের হলে আর ফিরে আসেননি, অনেক খোঁজখবর নেওয়ার পর শোনা যায় তার বাবা জোয়ানা কোচে এক্সিডেন্টে মারা গেছেন।

গাড়ির ড্রাইভার জানান, জানালা দিয়ে মাথা বের করার সময় বমি করতে গিয়ে আর এক গাড়ির ঘর্ষণে আঘাত পেয়ে মারা গেছেন। মৃত্যু হয়েছে বটে তবে এ মৃত্যুর রহস্য বেশ ভারী। গাড়ির যাত্রীরা কেউই বলতে পারেননি সেদিনের দুর্ঘটনার কথা। তাজমিনের মা স্বামীর লাশ পর্যন্ত ফেরত পাননি। অনেকবার গাড়ি সমিতিতে ঘোরাঘুরির পর মাত্র বিশহাজার টাকা হাতে পায়, স্বামীর জীবনের মূল্য মাত্র বিশ হাজার! নাকি তাজুদের মত পরিবারের জীবনের দামই এই অল্প কয়েক কড়ি? কে জানে! অভিমান মিশ্রিত শতশত নীরব প্রশ্নের অভিযোগ বা আবদার করার মত কোনো আদালত পায়নি তাজুর মা! তাজু অবুঝ, সে আজও বাবার প্রত্যাশায় চেয়ে আছে বাবা তার ফিরে আসবে।

কত স্বপ্ন কত প্রাণ এভাবে ঝরবে কেউ জানেনা! আসুন তবে, নিরাপদ সড়কের কথা প্রথমত না ভেবে নিরাপদ জীবন নিয়ে ভাবি সঠিক নিয়মে, প্রশিক্ষণে, নিজেকে দক্ষ নাবিক হিসেবে তৈরি করি জীবন চলার পথে- নিরাপদের সিঁড়িপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দূর করি হাতে হাত মিলিয়ে সকল বাধা। প্রাণ দেবোনা সড়ক দুর্ঘটনায় চলবো পথ সজাগ সচেতনতায়- এই শ্লোগান নিয়ে পথ চলা হোক আমাদের সকলের।

জুঁই জেসমিন: লেখক ও মানবাধিকার কর্মী

juijesmin2019@gmail.com

 

Print Friendly

Related Posts