প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে পায়রা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার

আ হ ম ফয়সল, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে ফিরে পায়রা বন্দর নির্মানের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের স্থায়ী পুনর্বাসনের পর পর্যায়ক্রমে কারিগরী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ধরণের প্রশিক্ষণ পেয়ে অনেকে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়েছে আবার অনেকে প্রশিক্ষণ নিদের্শণা মোতাবেক বিভিন্ন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্বাবলম্বি হতে শুরু করেছেন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র (ডরপ) বন্দর নির্মানে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা ও চাহিদা অনুযায়ী জীবন যাত্রার উন্নয়নে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। পায়রা বন্দর নির্মানে প্রায় ৪২শ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তিন সপ্তাহ ও একমাসের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীগণ প্রতিদিন ৩০০টাকা ও তিন মাস ও ছয় মাসের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীগণ প্রতিদিন ৫০০টাকা করে প্রশিক্ষণ ভাতাও পেয়ে থাকেন।

ডরপ সূত্রে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে র্ডপ আগষ্ট ২০১৮ থেকে জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ১১৩৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে ১০টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। পরবর্তীতে ডরপ দ্বিতীয় পর্যায়ে চলতি বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত বেসিক কম্পিউটার, গাড়ী চালক, রাজমিস্ত্রি, পোষাক তৈরি, ওয়েলডিং, ছাগল পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, ব্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালন, মৎস্য চাষ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ, উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস মুরগী পালন ও হাঁস মুরগীর খাদ্য তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার পূর্বক পারিবারিক পরিমন্ডলে গাভী পালন ট্রেডে ২৬টি ব্যাচে মোট ৬৬৬ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। তার মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত ১৫০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পূর্ণ করেছে। প্রতি ব্যাচে সর্বনিন্ম ২৫ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে থাকেন।

ডরপ’র এ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের টিম লিডার জেবা আফরোজা জানান, বর্তমানে লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ, ধানখালি ইউনিয়ন পরিষদ, কেআইআইটি ও মাল্টিপারপাস বিল্ডিং, পায়রা বন্দর, কলাপাড়া ও পটুয়াখালীতে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। ৬ মাস, ৩ মাস, ১ মাস, ২১দিন মেয়াদি প্রশিক্ষণ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ গুলো মাধ্যমে দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তার মাধ্যমে যেমন- পশুসম্পদ কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাগণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

পায়রা বন্দর প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন এম. মুনিরুজ্জামান জানান, সরকার পায়রা বন্দর নির্মানের ফলে ভূমি ও গৃহ অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে পুনর্বাসনের পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান যাতে ব্যহত না হয়, তারা যাতে উন্নত জীবন যাপন করতে পারে সে জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করতে তাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণের পর তাঁরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। তারা ব্যবসা করে তাদের জীবন মান উন্নয়ন করতে পারছে। প্রশিক্ষণ পাবার পর তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তণ এসেছে। আমরা এ কাজে অভিজ্ঞ এনজিও ডরপ’র সহযোগীতায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। ওনাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রশিক্ষণ পরবর্তী মনিটরিং কার্যক্রমও নিয়মিত হচ্ছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মুনিবুর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসন জরুরি। পরিবারের উন্নয়নে চাহিদা মোতাবেক তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মানুষের পেশা পরিবর্তন করা কঠিন কাজ। মানুষিক পরির্বতনে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তাদের মানুষিক ভাবে সাহস সঞ্চয় করানো উচিত। প্রশিক্ষণ গুলোতে এ বিষয়ে একটি সেশন থাকা উচিত। টেকসই উন্নয়নে প্রশিক্ষণ পরবর্তি পরিবার গুলোতে ফলোআপ জরুরি।

dorp

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের নাসিমা বেগম ডরপ থেকে উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস-মুরগী পালন ও হাঁস-মুরগীর খাদ্য তৈরী প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ৪০০ হাঁসর কিনে খামাড় গড়ে তুলেছেন। সাম্প্রতিক বুলবুলের বন্যায় তার ১৫০টি হাস মারাগেলেও নাসিমা বেগম মনোবল হারাননি। বর্তমানে ১৫০টি হাঁস ডিম দিচ্ছে। তা বিক্রি করে দৈনিক ১৫শ টাকা আয় করছেন। নাসিমা বেগমের স্বামী হেলাল ফকির স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকানদার। নাসিমা বেগম খামার বৃদ্ধি করার জন্য ডরপ এর সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি আমাদের বলেন, আমি প্রশিক্ষণে যা শিখেছি তা কাজে লাগিয়ে হাঁস লালন পালন করছি। আমার এই খামার দেখে এলাকার অনেকে খামার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমি তাদের সহযোগিতা করবো। আমি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ডরপ এর নিকট কৃতজ্ঞ। আগামীতে নাসিমা বেগম হাঁসের পাশাপাশি মুরগীর খামার গড়েতোলার পরিকল্পনা করছেন।

একই ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামের মোসা: হাসিনা বেগম। পায়রা বন্দর বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য হিসাবে ব্র্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালনের উপর ১মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাসিনা বেগম প্রশিক্ষণ পরবর্তী ৪হাজার টাকা দিয়ে ৫টি টার্কি ক্রয় করেন। তিনি বলেন, আমি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যা শিখেছি টার্কিগুলো কেনার পর তাদের সেভাবে যত্ন নেই, টিকা দেই, সুষম খাবার দেই এবং ১ মাস পর টার্কিগুলো ডিম দেয়া শুরু করে। আমি সেই ডিম দিয়ে টার্কির বাচ্চা ফুটিয়ে বর্তমানে ৪০টি টার্কি দিয়ে খামার গড়ে তুলি। আমার এ সাফল্য দেখে এলাকার অন্যান্যরা আমার কাছ থেকে ডিম ক্রয় করে। এ পর্যন্ত আমি প্রায় ১০ হাজার টাকার ডিম বিক্রি করেছি। আমার আয়ের টাকা সংসারের বিভিন্ন কাজে লাগাই। পরিবারে এবং সমাজে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

কলাউপাড়া গ্রামের একই বাড়ির জাহিদা বেগম, সাহেদা বেগম, হালিমা বেগম প্রশিক্ষণ পাবার পর তিনজনই ভিন্ন-ভিন্ন ভাবে ব্রয়লার সোনালী মোড়গের খামার গড়ে তুলেছেন। ইতোমধ্যে তারা মুরগী বিক্রি করে আয় করতে শুরু করেছেন। পার্শ্ববর্তী মঞ্জুপাড়া গ্রামের ডরপ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রিনি বেগম প্রশিক্ষণ ভাতা ৭ হাজার টাকাসহ ২৮ হাজার টাকা দিয়ে হাঁস কিনে খামাড় গড়ে তুলেছেন। পরবর্তীতে বড় ৪শ ও ছোট ৪শ হাঁস দিয়ে খামাড়ের পরিসর বড় করেন। রিনি বেগমের স্বামী জাকারিয়া হাওলাদার আগে বাহিরে কাজ করতো, এখন তিনি নিজেদের হাঁসের খামারেই শ্রম দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি ৫০ হাজার টাকার হাঁস বিক্রি করেছেন। আগামীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খামার বড় করবেন বলে জানান।

পায়রা বন্দর এলাকায় সকালের ব্যাচে ইয়াহিয়া, মোঃ সোহেল মৃদা, মিজানুর রহমান, কাকলি আক্তার, জুথি খানম, নিপা আক্তার, রোকেয়া মৌসুমিসহ ২৫জন শিক্ষার্থীকে বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ক্লাসে দেখা গেছে। কম্পিউটার ক্লাসের প্রশিক্ষক সাদিয়া আক্তার ও সুব্রত সিকদার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তারা জানান, নির্ধারিত কারিকুলাম ধরে তাদের ৬মাসের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রতিদিন দুইটি ব্যাচে প্রশিক্ষণ ক্লাস হয়ে থাকে।

বানাতিপাড়া গ্রামের রিয়া মনি একজন গৃহিনী। স্নাতক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পায়রাবন্দর বাস্তবায়নের জন্য তাদের জমি-জমা অধিগ্রহণ করা হয়। তিনি তার পরিবারের পক্ষে ৬ মাস ব্যাপি বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ পান। তিনি বলেন, এ প্রশিক্ষণ আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বানাতি বাজারে অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট শাখায় আমার চাকুরী হয়। আমার মাসিক বেতন এখন ১২হাজার টাকা। এইভাবে জাহাঙ্গীর আখন্দের ছেলে হারুনুর রশিদ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাবার পর বানাতি বাজারে কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিক্রির দোকান দিয়েছেন। এখন দোকান থেকে হারুনুর রশিদ প্রতিমাসে নূনতম ১০ হাজার টাকা আয় করেন।

এদিকে বানাতিপাড়া গ্রামের মনির গাজী দীর্ঘদিন ধরে রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসাবে কাজ করতেন। র্ডপ থেকে তিন মাসের রাজমিস্ত্রির প্রশিক্ষণ পাবার পর তিনি এখন মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ পাবার পর মিস্ত্রির কাজ করায় মনির গাজীর রোজগারও বেরে গেছে। মঞ্জুপাড়া গ্রামের আবুল কাশেম প্রশিক্ষণ পাবার পর ২৪ হাজার টাকা খরচ করে পুকুরে তেলাপিয়া মাছের চাষ শুরু করেছেন। তিনি আশা করছেন মাছ বিক্রি করে তার ভালো আয় হবে। প্রশিক্ষণ পাবার পর পার্শবর্তী রাশিদা বেগম পায়রা বন্দর থেকে বাড়ির ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দুইটি গরু কিনেছেন। একই গ্রামের ৫শ হাঁস দিয়ে খামাড় গড়ে তুলেছেন মোসাম্মৎ হেলেনা। তিনি জানান, ডরপ এর প্রশিক্ষণ পাবার আগে হাঁস পালনের বহু চেষ্টা করেছি কিন্তু সব সময় হাঁস মরে যেত। এখন আর কোন হাঁস মরেনি। ঋণ নিয়ে খামার বড় করার স্বপ্ন দেখছেন হেলেনা।

প্রশিক্ষণ পরবর্তীতে এরকম একের পর এক বাস্তব সাফল্যের গল্প তৌরি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে। পায়রা বন্দর নির্মানে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন পরিবারের সদস্যদের মাঝে নতুন করে উন্নয়নের পথযাত্রায় সবার চোখে-মুখে হাসি ফুটছে।

 

Print Friendly

Related Posts