অদক্ষ জনবলকে দক্ষ জনবলে রূপান্তরে বাংলাদেশের দুর্বলতাসমূহ

প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান

বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অদক্ষ জনশক্তির তুলনায়, দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশী রেমিট্যান্স অর্জন করা সম্ভব। তাই জাতীয় উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই।

সরকার অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করণের ফলে বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। এছাড়াও প্রতিবছর ১০ লক্ষাধিক লোক বৈদেশিক কর্মসংস্থানে যাচ্ছে। প্রবাসী কর্মীর মাধ্যমে প্রাপ্ত বৈদেশিক রেমিট্যান্স, আজ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে সরকারের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। (ক) দেশের কৃষক (খ) প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশী (গ) গার্মেন্টস শিল্প (ঘ) বেসরকারী খাতের শিল্পোদ্যোক্তা ও (ঙ) নানান পেশার পেশাজীবী মানুষ।

সরকার দক্ষ জনবল তৈরির জন্য বিএমইটি’র আওতাধীন ৬৪টি টিটিসি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে অর্ধশতাধিক ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো অভাব নেই। পলিসিগত দুর্বলতা কাটানো গেলে কাক্সিক্ষত মাত্রায় দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

যেমন :

(১) দক্ষতা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা।

কারিগরি শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষন; শব্দ দুটি সমার্থক মনে হলেও শিক্ষা ও প্রশিক্ষন শব্দ দুটি সমার্থক নয়। আমরা সবাই জানি; শিক্ষা হলো- সার্বিক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য এবং প্রশিক্ষন হলো- পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম প্রনয়ন, মান উন্নয়ন ও সনদায়নের জন্য যেমন কারিগরি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। তেমনি কারিগরি প্রশিক্ষন তথা দক্ষতা উন্নয়নের কারিকুলাম প্রনয়ন, মান উন্নয়ন ও সনদায়নের জন্য আলাদাভাবে দক্ষতা উন্নয়ন বোর্ড বা এইচআরডি সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আলাদা কোন বোর্ড/ সার্ভিস সেন্টার নেই। যার ফলে বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদিচ্ছার উপর অনেকটা নির্ভরশীল।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লক্ষাধিক জনবল কর্ম বাজারে প্রবেশ করে। উক্ত শ্রমশক্তিকে দেশ-বিদেশের কর্ম-উপযোগী দক্ষ-জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষে ২৩টি মন্ত্রনালয় বা বিভাগ তাদের নিজস্ব কারিকুলাম অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উক্ত কার্যক্রম সমন্বয় করার স্বার্থে কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের ন্যায় আলাদাভাবে দক্ষতা উন্নয়ন বোর্ড বা মানব সম্পদ উন্নয়ন সেবা কেন্দ্র (HRD Service centre) প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (NSDA)/ বিএমইটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

(২) NTVQF লেভেল রি-ডিজাইন করা।
ফিলিপিন, শ্রীলংকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের যোগ্যতা/ দক্ষতা কাঠামোতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নীচে ০৪টি দক্ষতা উন্নয়ন লেভেল রয়েছে। আবার সিঙ্গাপুর, চীন ও কোরিয়াতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নীচে ০২টি দক্ষতা উন্নয়ন লেভেল রয়েছে। তারমধ্যে মাধ্যমিক লেভেলে ০১টি ও উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলে ০১টি দক্ষতা উন্নয়ন লেভেল রয়েছে। বাংলাদেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নীচে (৫+২)=৭টি দক্ষতা উন্নয়ন লেভেল রয়েছে। যেখানে ভর্তি যোগ্যতা, সনদপত্রের শিরোনাম ও জব ক্লাসিফিকেশন সুস্পষ্ট নয়। এমতাবস্থায় দ্রæত দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নীচে মাধ্যমিক লেভেলে ০২টি ও উচ্চ মাধ্যমিক (HSC)) লেভেলে চীন, কোরিয়া ও সিংগাপুর -এর ন্যায় আন্তর্জাতিক মানের ০১টি সার্বজনীন দক্ষতা উন্নয়ন কোর্স প্রবর্তন করা যায়।

যেমন :
ক) প্রাথমিক শিক্ষা শেষে স্কুল ছেড়ে আসা লোকদের, সহকারী টকেনশিয়িান/ হেল্পার হওয়ার জন্য ৬০ – ৭০ ঘন্টার প্রশক্ষিণ দিয়ে প্রাইমারি স্কিল সার্টিফিকেট প্রদান করা যায়।
খ) অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষা শেষে স্কুল ছেড়ে আসা লোকদের, টেকনশিয়ান/ মেকানিক্স হওয়ার জন্য ৩৬০- ৪০০ ঘন্টার প্রশিক্ষণ দিয়ে জুনিয়র স্কিল সার্টিফিকেট প্রদান করা যায়।
গ) উচ্চতর দক্ষতা সম্পন্ন জনবল সৃষ্টির লক্ষে -এসএসসি পাস শিক্ষাথীর্দের সিনিয়র টেকনশিয়ান/ সিনিয়র মেকানিক্স হওয়ার জন্য দুই বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে HSC (Technical)/ Senior Skill Certificate  প্রদান করা যায়।

khalil
(৩) দক্ষতা উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন অধিদপ্তর নাই। বিএমইটি মূলত বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। যা তার নামের সাথে (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষন ব্যুরো) সংগতিপূর্ণ নয়। সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষন ব্যুরো (বিএমইটি)কে ০২টি অধিদপ্তর করার প্রস্তাব রয়েছে। যার মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান অধিদপ্তর ও দক্ষতা উন্নয়ন অধিদপ্তর রয়েছে। যা বাস্তবায়ন করা যায়।

(৪) কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষকদের প্রতিটি পদে একটি বেতন স্কেল নির্ধারণ পূর্বক শূন্য পদ পূরণ করা।
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এর শিক্ষকদের তিনটি পর্যায়ক্রমিক প্রশিক্ষক পদে একই বেতন গ্রেড (১০ম গ্রেড) এবং সিনিয়র ইন্সট্রাকটর ও ইন্সট্রাকটর পদে একাধিক বেতন গ্রেড থাকায় শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

টিটিসি’র প্রশিক্ষকদের বেতনগ্রেড সমূহ :
khalil-1
উল্লেখ্য- বাংলাদেশ সরকার ১৯-১১-১৯৯৪ খ্রি. তারিখে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন স্কেলসমূহ আপগ্রেড করে ১০ম গ্রেড নির্ধারণ পূর্বক ২য় শ্রেণির গেজেটেড পদ মর্যাদা প্রদান করেছেন।
ফলে টিটিসি-তে কর্মরত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার প্রশিক্ষকদের ০৩টি পদেই ১০ম গ্রেড ও গেজেটেড পদ মর্যাদা সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত আদেশ বলে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টসমূহ নিয়োগবিধির বেতন গ্রেডসমূহ সংশোধন করলেও বিএমইটি’র প্রশিক্ষকদের নিয়োগ বিধির বেতন গ্রেড সংশোধন না হওয়ায় একই পদে একাধিক বেতন স্কেল রয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে চীফ ইন্সট্রাকটর পদ- ৯ম গ্রেড, সিনিয়র ইনস্ট্রাকটর পদ- ১০ম গ্রেড ও ইন্সট্রাকটর পদ- ১২তম গ্রেড নির্ধারন পূর্বক অফিস আদেশ জারী করা গেলে সহস্রাধিক শুন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হবে এবং দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

(৫) দক্ষতা উন্নয়ন বাস্তবায়নকারী সংস্থাসমূহকে বিসিএস ক্যাডারভূক্ত করা।
“কারিগরি শিক্ষা” ও “কারিগরি প্রশিক্ষণ”-কে গতিশীল ও শক্তিশালী করার জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাসমূহকে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করা যায়।

 

প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান: সাবেক পরিচালক, বিএমইটি।

Print Friendly

Related Posts