বাঙালি জাতির সর্বোচ্চ গৌরবের দিন

মো. জাকির হাসান পিন্টু

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, নির্যাতনের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে সর্বোচ্চ গৌরবের একটি অবিস্মরণীয় দিন। জীবন দিয়ে যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জিত হয়। যতদিন পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন এই দিনটির গুরুত্ব ও সম্মান অক্ষুন্ন থাকবে।

৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরের দিন বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা আসতে থাকেন রাজধানী ঢাকায়। বিজয়ের কাক্সিক্ষত এ দিনটির জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কাল। একটি রাষ্ট্রের পেছনে হাজার বছরের ইতিহাস থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যে নির্দিষ্ট অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলছি, তা তো মাত্র ৪৮ বছর আগের অর্জন।

বিজয়ের এই মুহূর্তে পেছন ফিরে নিরাসক্তভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন নেহাত কম নয়। নানা দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বাংলাদেশের বিশাল কর্মযজ্ঞের নানা দিকের স্বীকৃতিও বিশ্বের মানুষ দিচ্ছে। বাংলাদেশের এ অর্জন দেশের মানুষের গৌরবকে যে হিমালয়তুল্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমাদের প্রথম সংবিধান পৃথিবীর যেকোনো উন্নত রাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে। কিন্তু গত সাড়ে চার দশকে এই সংবিধানের বহু কাটাছেঁড়া হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মূল স্তম্ভগুলোর অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা, তথা অসাম্প্রদায়িকতা বর্তমান সময়েও বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা সরকারসহ সাধারণ মানুষের জন্য রীতিমতো আতঙ্কজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটি হলো উগ্রপন্থী মনোভাবের উত্থান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য এদের সমূলে উচ্ছেদ করতেই হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করতেই হবে। ভুললে চলবে না, এই বাংলাদেশ বহু মানুষের রক্তে কেনা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ও বিজয়ের ক্ষণটি আমার পক্ষে কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই ক্ষণ আমি দেখেছি এবং তাতে অংশ নিয়েছি। সোনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আমার অস্তিত্বের অন্তস্তলে তা গেঁথে আছে। বাঙালি জাতির ইতিহাস লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, আত্মত্যাগের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথ ধরেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলা ভাঙতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি চূড়ান্ত বিজয়ের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ও নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি জাতি। ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শুরু করে গণহত্যা। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে এই যুদ্ধ। পাক হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ভেঙে দিতে শুরু করে বর্বর গণহত্যা। গণহত্যার পাশাপাশি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় হানাদাররা।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এগিয়ে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন। সম্ভ্রম হারার দুই লাখের বেশি মা-বোন। সর্বস্তরের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও এদেশের কিছু মানুষ, জাতির কুলাঙ্গার সন্তান পাক হানাদার বাহিনীর পক্ষ নেয়। রাজাকার, আল বদর, আল সামস বাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞে মেতে উঠে তারা।

বিজয়ের আনন্দ সবচেয়ে আলাদা। আর তা যদি হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জয়, তবে সেই আনন্দ বর্ণিল ও গৌরবের। আমরা সেই সৌভাগ্যবান জাতি যাদের আছে বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার একটি দিন। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সাধারণ কোনো দিন নয়। এদিন প্রথম শেকল ভেঙে উড়েছিল বাঙালির মুক্তির পতাকা। লাখ লাখ প্রিয়জনের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা, অশ্র“ বিসর্জনে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের কাছে সবচেয়ে গৌরবের। প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে জীবন দিয়ে গেছেন আমাদের আপনজনরা- এর চেয়ে শ্রদ্ধার, এর চেয়ে ভালোবাসার আর কী-বা হতে পারে! তাইতো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে নিয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পতাকা। প্রতিবছর বিজয় দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে এবং বিশ্বকে বার বার মনে করিয়ে দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, বীর শহীদদের কথা।

প্রায় দিশেহারা একটি জাতির সামনে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ছিল আলোকবর্তিকার মতো। যখন পরাধীনতা ও দাসত্বের শেকলে আটকা পড়েছিল দেশ, এমন এক দুঃসময়ে সাহস এবং অপরাজেয় সংকল্পের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন অসাধারণ দৃঢ় চরিত্রের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তিনি তার পুরো জীবন ব্যয় করেছিলেন ঘুমন্ত জাতির জাগরণের পেছনে। আত্মশক্তিতে শক্তিশালী করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার দিকে। জাতির জনকের মতো নেতাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এ বাংলাদেশ। তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। আমাদের বিজয়ের ইতিহাস বড় সমৃদ্ধ ও আত্মত্যাগের। তবে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বিজয় দিবসকে সীমাবদ্ধতা না রেখে কষ্টার্জিত স্বাধীনতার যথাযথ সংরক্ষণে আমাদের এদিনে বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা গতিশীল, প্রকৃত আদর্শকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান ও ক্ষমতা অনুসারে এদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করতে হবে। জাতির জনকের স্বপ্নের দেশটি যেন কখনও মলিন না হয়। আমাদের আগামীর প্রজন্মকে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে হলে শুধু বিজয়ের মাসে আবদ্ধ না রেখে দৈনন্দিন জীবনে নিজ কাজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হবে।

মো. জাকির হাসান পিন্টু: বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, সহসভাপতি- উদয়াচল ক্লাব, কাউন্সিলর-বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।

Print Friendly

Related Posts