চলে গেলেন বীরকন্যা আফিয়া খাতুন খঞ্জনী

জেসমিন আক্তার

মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি অনেক নারীর অংশগহণ ও অবদান ছিল তাক লাগানোর মতো। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়ে, জীবন দিয়ে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন যারা- তাদের ঋণ কোনদিনই শোধ হবার নয়। কুমিল্লার বীরকন্যা মুক্তিযোদ্ধা আফিয়া খাতুন খঞ্জনী তেমনই এক যোদ্ধা, যার ত্যাগ ও বীরত্ব নিঃসন্দেহে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথটিকে অনেক সহজতর করে তুলেছিল।

কুমিল্লার এই বীরকন্যা সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) রাত ৯:৩০ টায় বার্ধক্যজনিত কারণে বাগিচাগাঁওস্থ মেয়ের বাসায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বাদ জোহর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নির্বাহী অফিসার মাসুদ রানার নেতৃত্বে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাপুর গ্রামে সমাহিত করা হয় এই বীরকন্যাকে।

ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শামসুন্নাহার রহমান পরাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ নির্যাতিত নারীকে পরিত্যক্ত গোয়াল ঘর থেকে উদ্ধার করে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধ শেষে আফিয়া খাতুন খঞ্জনী পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প থেকে ঘরে ফিরে আসলে তাঁকে নষ্টা নারী আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়। অথচ এ খঞ্জনীই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা করেন, নিজের সর্বস্ব দিয়ে। সমাজচ্যুত খঞ্জনী পরবর্তীতে এলাকা ছেড়ে অনাহরে, দুঃখ-কষ্টে নিরুদ্দেশ হলে পরাণ রহমান তাঁকে খুঁজে বের করেন। তাঁর মৃত্যুতে বেসরকারি সংস্থা ‘ঘাসফুল’ পরিবার গভীর ভাবে শোকাহত। এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঘাসফুল এ নির্যাতিতা নারী মহান মুক্তিযোদ্ধার জীবদ্দশায় সার্বনিক পাশে থাকতে পেরে গর্বিত।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বর্বরোচিত ভাবে লাঞ্ছিত হন সোনাপুরের বউ আফিয়া খাতুন খঞ্জনী। তিনি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথ দিঘী ইউনিয়নে সোনাপুর গ্রামের বউ। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই মহান মুক্তিযোদ্ধা বীরকন্যা মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। কেউ তাঁর খোঁজ রাখেনি। ঘাসফুল প্রতিষ্ঠাতা, নারীনেত্রী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শামসুন্নাহার রহমান পরাণ দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লার পথ-প্রান্তরে খঞ্জণীর খোঁজ করছিলেন। অবশেষে খঞ্জনীর খোঁজ পেলেন শামসুন্নাহার রহমান পরাণ। তিনি ২০০০ সালের ৩ মার্চ দৈনিক আজকের কাগজে “একাত্তর-এর ঘাতকদের হাতে বন্দি কোনো মানিকের বৌ” শীর্ষক একটি ফিচার লিখেন।

afia-2
মুক্তিযোদ্ধা আফিয়া খাতুন খঞ্জনী ও ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা শামসুন্নাহার রহমান পরাণ

শামসুন্নাহার রহমান পরাণের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত ২২ মার্চ ২০০০ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় নারীমঞ্চে, “কী ছিল তার অপরাধ” এবং ৫ ডিসেম্বর ২০১১ সালে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়“ কুমিল্লার বীরাঙ্গনা খঞ্জনীর স্বীকৃতি মেলেনি এখনও” শীর্ষক দুইটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপানো হয়। তারপর তার নিজের লেখা আজকের কাগজে প্রকাশিত ফিচার এবং অন্য দুই পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন নিয়ে শামসুন্নাহার রহমান পরাণ দীর্ঘদিন ধরে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা বীরকন্যা খঞ্জনীর বীরত্বের স্বীকৃতি এবং সাহায্যার্থে বিভিন্ন মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান এবং বিভিন্ন জায়গায় তার সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে ২০১৩ সালে এসে শামসুন্নাহার রহমান পরাণের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন নারীপক্ষ নামে একটি নারী সংগঠন। ঘাসফুলের মাধ্যমে নারীপক্ষ প্রতি মাসে ১২০০/- (এক হাজার দুইশত) টাকা হারে মাসিক ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৪ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করেন যা ২০১৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

তারই ফলশ্রুতিতে প্রয়াত পরাণ রহমানের নির্দেশনায় গত ১০ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে কুমিল্লার স্থানীয় দুইটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একজন সহকারী শিক্ষক ও পাড়া-পড়শিসহ পঞ্চাশ জনের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা বীরকন্যা আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে বীরত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয় – এটাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর প্রথম স্বীকৃতি। পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। পরাণ রহমান মুক্তিযোদ্ধা বীরকন্যা আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে বীরাঙ্গনা নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ রাষ্ট্রিয় ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে লিখিতভাবে আবেদন করেন।

গত ২৭ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেন’স এর ৩৭ বছর উপলক্ষে এই বীরকন্যাকে সম্মাননা প্রদান করেন এবং ১০ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৩৭তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা বীরকন্যা আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির ফলে কেবল আফিয়া খাতুন খঞ্জনীই সম্মানিত হননি বরং প্রকৃত বীরকন্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম এই বাংলাদেশ।

জেসমিন আক্তার : সহকারী ব্যাবস্থাপক, ঘাসফুল পাবলিকেশন্স।

Print Friendly

Related Posts